অপূর্ব সাহা




শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

জীববিজ্ঞানীরা বিবর্তনবাদের আলোকে ব্যাখ্যা করেন ধর্ষণ ব্যাপারটিকে [দ্র থর্ণহিল ও অনান্য (১৯৮৬)] তাদের মতে ধর্ষণ পুরুষের এমন আচরণ , যা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বিবর্তনতত্ত্বের বিরোধী তবে তাঁরা মনে করেন ধর্ষণ হয়তো বিবর্তনের ফলে উদ্ভূত বিশেষ শর্তনির্ভর এক আচরণ -মত অনুসারে ধর্ষণে লিপ্ত হয় সে-পুরুষেরাই, যারা কাঙ্খিত সঙ্গিনীকে পাওয়ার প্রতিযোগিতায় ব্যর্থ, যারা প্রয়োজনীয় সম্পদ আর মর্যাদার অধিকারী নয় -মতের ভিত্তি হচ্ছে বলপ্রয়োগে সঙ্গমের তুলনামূলক জীববিজ্ঞান জীববিজ্ঞানীরা প্যানোর্পা প্রজাতির বৃশ্চিক মক্ষিকার আচরণ পর্যবেক্ষণ করে কীভাবে বল প্রয়োগে সঙ্গমের উদ্ভব ঘটেছে, সে- সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁচেছেন ব্যাপারটি এমন পুরুষ প্যানোর্পা করে থাকে তিন রকম যৌন আচরণ প্রথম আচরণ দুটি বেশ মধুর, বেশ সফল পুরুষের আচরণ: -ক্ষেত্রে পুরুষ প্যানোর্পা বিনামূল্যে কাম চরিতার্থ করতে চায় না; সে সঙ্গম চায় খাদ্যের বিনিময়ে- সে সঙ্গমের আগে নারী প্যানোর্পার সামনে খাবার রাখে; নারী প্যানোর্পাটি যখন খাবার খেতে থাকে, তখন পুরুষটি সঙ্গমের কাজ সম্পন্ন করে তৃতীয় আচরণটি হচ্ছে সবল সঙ্গম বা বলাৎকার বা ধর্ষণ -ক্ষেত্রে পুরুষ প্যানোর্পা নারী প্যানোর্পাকে কোনো সঙ্গমপূর্ব খাবার দিতে পারে না, তাই নারী প্যানোর্পাকে সে আকৃষ্ট করতে পারে না নারী প্যানোর্পা তার আবেদনে সম্মত হয় না বলে সে বল প্রয়োগ করে পাশ দিয়ে কোনো নারী প্যানোর্পা যাচ্ছে দেখলেই পুরুষ প্যানোর্পা তার দিকে ছুটে যায়, নিজের নমনীয় তলপেট বাড়িয়ে দেয় যদি সে নারীটির একটি পা বা পাখা আটকে ধরতে পারে, তবে সে নারী প্যানোর্পাটিকে স্থাপন করে নিজের জন্যে সুবিধাজনকভাবে, বল প্রয়োগে কাবু করে ফেলে নারী প্যানোর্পাটিকে, এবং শক্ত করে ধরে সঙ্গম এর কাজ সম্পন্ন করে পুরো কাজের সময় সে নারী প্যানোর্পাটিকে শক্ত ভাবে ধরে রাখে পুরুষ প্যানোর্পার  -বলাৎকারকে কিছুতেই অস্বাভাবিক বা বিকৃত আচরণ বলা যায় না;- প্যানোর্পাদের সমাজ রাষ্ট্র সভ্যতা বিজ্ঞান দর্শন মনোবিজ্ঞান নেই কিছু কিছু পুরুষ প্যানোর্পার মধ্যে এ-ধরনের আচরণের বিকাশ ঘটেছে বিবর্তন এর ফলেই

[ উৎস: ধর্ষণ // নারী // হুমায়ুন আজাদ। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর ]

২.

স্টপ চিনে ঠিক নামতেই পারল না অনিমা। আন্দাজে রাস্তার নাম জিজ্ঞেস করতে করতে তবে গলির মুখটা পেল। মুঠোকতক নতুন দোকানে গলির মুখটা এমন বদলে গেছে। তার মধ্যেও অনিমা ঠিকঠাক দেখে নিল, সেই পুরনো ডিসপেনসারিটা কী অবস্থায় আছে। সদ্য বিয়ের পর এখানেই একটা কুড়ি টাকার ঘরে উঠেছিল তারা। দু সংসার থেকেই আলাদা। শুধু সুরেনের সঙ্গে।

গলিটা তিন চারটে গোঁত্তা খেয়ে যেখানে আরও দুটো বাইলেনের ফেঁকড়ি বের করেছে, সেখানেই ওই ঝুরঝুরে বাড়িটায় অনিমার প্রথম সংসার। সেই গ্যাসপোস্টটা এখনও তেমনি রয়েছে। শুধু আদৌ জ্বলছে না। বদলে একটা বাড়ির গা থেকে তার ঝোলানো একটা নেড়া ইলেক্ট্রিকের বাল্ তার ঘোলাটে আলোয় অনিমার ঘরের সেই জানলাটা দেখা যাচ্ছে। পর্দাহীন জানলায় বসে বসে দুটি শিশুর ছায়ামূর্তি বাটি কুড়িয়ে কী সব খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে, ভিতরের দেওয়ালের রং তামাটে। বিছানা, বালিশ তোষক পুরনো বই, মিক্সচারের শিশি এইসব তালগোল পাকানো। টাল করা। অথচ এক সময় ওই ঘরই কী ছিমছাম সাজানো গোছানো ছিল। জানলা দিয়ে নীলচে গ্যাসের আলো পড়ে বিছানাটাকে পরীরাজ্য করে দিত। রাতে ঘুম ভেঙে গেলে হঠাৎ অনিমার মনে হত, এ কোথায়? কার পাশে শুয়ে আছে সে!

বারোয়ারি সদর পেরিয়ে ভেতরে ঢুকল অনিমা। মাঝে সেই পিছল উঠোন, চারপাশে রক, আর সার সার ভাড়াটে কুঠরি। ঘরে ঘরে স্ত্রী-পুরুষ-বাচ্চার কচাকচি। রেডিও। শ্যাওলা পড়া মাছ ধোয়া জলের আঁশটে গন্ধ ওঠা উঠোনে বিগড়ে যাওয়া কল থেকে ছড়ছড় জল পড়ার বিরক্তিকর আওয়াজ। অনিমার ঘরের সামনে একটি বউ তোলা উনুনে রুটি করছিল। অনিমা ছায়ার মধ্যে কালো মূর্তির মতো দাঁড়াতেই জিজ্ঞেস করল– কাকে চাইছেন?

অনিমা প্রাণপণে তার সময়কার পুরনো বাসিন্দাদের নাম মনে করতে চাইল তারপর চট করে বল, - আচ্ছা এই ঘরের পাশের ঘরের নার্স সুরোদিদি কি এখনও আছেন?

বউটি অবাক হয়ে বলল, কে নার্স সুরোদিদি?

-      আহা, তুমি জানবে কী করে? একরাশ ভিজে কাপড় কেচে কেচে বালতি বোঝাই করে প্রায় বেঁকে বেঁকে হাঁটতে হাঁটতে বলল একটি শীর্ণ বিধবা।

-      আর এই এ ঘরে যে একটি বউ ছিল, নতুন বিয়ে হয়ে আসা বউ।

শীর্ণ বিধবাটি ফোকলা দাঁতে একটু হেসে বললে, হ্যাঁ, তার গল্প শুনেছি। সুরোদিদির কাছেই। আহা তার বরটা নাকি তাকে খুব মারত। তবু নাকি সে শাড়ি কেটে পর্দা বানাত, ঘর সাজাত, স্বামীকে খুশি করবার জন্য কত রকম রান্না করত।

শুকনো-মুখ বিধবাটি উঠোনের আবছা অন্ধকারের দিকে চেয়ে যেন কেমন বেগতিক দেখে, একটু ভয় পেয়ে সারি সারি কুঠরির একটিতে অদৃশ্য হয়ে গেল। অনিমা এতক্ষনে ঠাহর করে দেখল উঠোনে হাঁটুর কাপড় তুলে কলে পা ধুচ্ছে যে ছায়ারঙের স্ত্রীলোকটি, বুকের অনাবৃত মাংসখণ্ড নিয়ে তার বিন্দুমাত্র লজ্জাবোধ নেই। কথা বলার আনন্দে সে খনখন গলায় ক্রমাগত কথাই বলে যাচ্ছে।

-      বউটা কিচ্ছু জানত না। পর্দা টাঙাত, না আরও কিছু। দশবার সব - খুলে পড়ে যেত  বরটা কচুর শাক নারকেল ঘন্ট ভালবাসত। ঘটির মেয়ে তো, জানত না কিছুই। তাই আমার কাছে শিখতে আসত। আবার কী লম্বা লম্বা কথা। একটা মাটির ভাঁড় কিনে এনে একবার বলে কি, মাস মাস পয়সা জমাব। একবছরে না হোক দশ পনেরো কুড়ি বছর পরে আমার বাড়ি হবে – আর বেশি নয় দুটো বাচ্চা! তা স্বামীটা ভাঁড়ে পয়সা পুরো হতেই ভেঙে সব নিয়ে নিল।

অনিমা অস্ফুটস্বরে বলল, তারপর!

[ উৎস: খেলতে খেলতে, একদিন // কবিতা সিংহ। গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা ]

৩.

সস্তা টিনের ঘর হলেও বাড়িটা তার ভাল লাগে। লোকজন একরকম নেই বললেই চলে। মোটে আর–একঘর ভাড়াটে। তাও ঠিক পাশাপাশি ঘর না। উঠোন পার হয়ে বাঁদিকের ভাঙা জিরজিরে একটা দেওয়াল ঘেঁষে ডুমুর আর পেঁপে জঙ্গলের আড়াল করা নিচু একচালার একটা খুপরি নিয়ে বুড়ো মানুষটা ওধারে পড়ে আছে। ওর থাকা না-থাকা সমান কথা। সারাদিনের মধ্যে এক-আধবার যদি কাশির শব্দ কি যন্ত্রপাতি চালাবার টুংটাং আওয়াজ কানে আসে- আসে না। ডুমুর গাছ পেঁপে জঙ্গল ভাঙা নড়বড়ে পাঁচিল সামনে নিয়ে ওইটুকুন ডেরার জং-ধরা পুরনো টিনের দরজার আড়ালে বসে দিনরাত বুড়ো ভুবন সরকার কী করে দেখবার তিলমাত্র কৌতূহল বা ইচ্ছাও অবশ্য তার হয় না। বরং যদি কেউ এখন মায়ার ঘরে উঁকি দেয় তো দেখতে পাবে দেওয়ালে টাঙানো একটা বড় আরশির সামনে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে ও নিজেকে দেখছে। দেখছে আর যেন আনন্দের আতিশয্যে মৃদ্যু শিস দেওয়ার মতন একটা গানের সুর জিহ্বা ও ঠোঁটের মাথায় জড়িয়ে রেখে রেখে তারপর একসময় নিজের নিশ্বাসের সঙ্গে বার করে সেটা ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে দিচ্ছে। গায়ের জামায় বোতাম নেই, আঁচলটা ঢিলে হয়ে মাটিতে লুটোয়, খোঁপার বাঁধন খুলে দেওয়াতে ঘাড়ে পিঠে কোমর অব্দি একরাশ কালো চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। মাঝারি গড়ন। রং খুব ফর্সা না। কিন্তু মুখখানা সুন্দর। অন্তত মায়ার নিজের কাছে নিজের ছোট্ট পাতলা কপাল আর দু’ধারে একটু বেঁকে যাওয়া না-সরু-না-মোটা ভুরু ও ঢালুর দিকে ঈষৎ ছড়িয়ে পড়া নাক ও কালো পালক ঘেরা চোখের লালচে মতন বা বলা যায় বাদামি রঙের চকচকে মণি দুটো অসম্ভব ভাল লাগে। হ্যাঁ, আর ওর কচি পেয়ারার মতন ছোট্ট সুগোল মসৃণ একখানা থুতনি। নিজের কাছে তো বটেই প্রণবের কাছেও এই চোখ এই নাক এই ভুরু গাল কপাল এবং বিশেষ করে শক্ত পালিশ গোল ছোট্ট থুতনিটা যে কত প্রিয় তা মায়া এই দু’বছরে বেশ বুঝে নিয়েছে। বাপ্, আদর করতে সকলের আগে প্রণব এই থুতনি ধরে নাড়া দেবে টিপবে রগড়াবে নয়তো থুতনির ওপর নিজের নাক কি গালটা চেপে ধরে ঘষবে। খসখসে গালের ঘষায় মায়ার থুতনির ছাল উঠে যায় যেন। কিন্তু তা কি আর কোনওদিন গেছে। দু’বছর আগে কুমারী বয়সে যেমন ছিল আজও সেই থুতনি নিটোল অক্ষত হয়ে নিজের জায়গায় চুপ করে বসে আছে। যেন এর ক্ষয় নেই বৃদ্ধি নেই জরা নেই। কচি পেয়ারা। তুলনাটা মনে করে মায়া হাসল। অথচ দু’-দুটো বর্ষায় না জানি কত সহস্র গাছের পেয়ারা বড় হল পাকল কি পাকবার আগেই পোকা কি বাদুড়ের কামড়ে নষ্ট হয়ে নীচে ঝরে পড়ল।

[ উৎস: গিরগিটি // জ্যোতিরিন্দ্র নন্দী। গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা ]


তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি অপূর্ব সাহা লিখলেন

১.

একটি নিমগ্ন

        ক্রমে তৃতীয় ছেড়ে উঠে

                  আসছে

গালের মেলোডি    টেনে     টেনে

টসটস করছে

          সন্ধিপুজো 

 ভক্তিগীতি থেকে ব্লেড পর্যন্ত

             অশ্রু চুরি করে সামান্য  

                             ঝাঁঝে

মিশেছে কোলাহল

আর           ডিনার রঙের স্পর্ধা

যে ন তো মা র প্লেটে কো নো দাঁ ত নে ই

 জলখাবার ও তার গ্রামার

            ধেবড়ে গেছে 

    মুছেগেছেতীব্রজুতোর

    নীচে

      শুধু রোদের দ্রৌপদী 

পড়ছে গালে

       এবং

           ব্রণ বাজছে দাগের


২.

তারপর

এভাবে কাছাকাছি আসি অন্য

যদিও মনে হয় বৃথা এই সন্ধ্যাপাত

কেবলই পর্দার সারাংশ নিয়ে ঝুলে থাকে

যেভাবে আচরণের পাশে শ্বাশ্বতীর চূড়ান্ত

কিছু লজ্জা ঝুঁকে পড়েছে সহজ

তবুও সাড়া মিললে কোথাও বরফ ও সাদা

অসুখ বলতে এইটুকুই ঘরময়

তার পেছনে ঢালু ছায়া, বয়স, জলপটি আর

৩.

চিরুনীর দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা নদী উদ্দাম তার আহা জল আর উপচে পড়া গন্ধপ্রতিটি বাঁক যেন রশিদ খানের বন্দিশ এমনই খেয়ালে ভেসে ভেসে যায় নৌকাবিনুনী ধরে গোল হয়ে যায় একএকটা দিন  পাড় ভাঙার শব্দে টলটল করে পায়ের আলতা তাকে কি তুমি ধুয়ে ফেলতে চাও?এইসময়ইতো মেঘ তার কামিজের গিঁট আলগা করে বলে

' আয়..  এদিকে আয় আয় বলছি…'

এই ডাক শুনে তীরের ঘাস ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে উপুড় করে রাখা বিকেলে মুখ ঘষতে ঘষতে অনবরত একটু আড়ালে তাদের এই ক্রিয়াপদ দেখে হাসে একটা উজ্জ্বল রাজহাঁস তার ডানার আকস্মিক ঝাপটে ঘাসের ঘুম ভারী হয়ে আসে এরপর আলো নিভে যায় এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পালকে জমতে থাকে অস্ফুট কাশির দানা জলে দুই পা ডুবিয়ে একাকী বসে থাকে চাঁদ

 হিম পড়ে নীচু স্বরে

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

No comments:

Post a Comment