সৌমনা দাশগুপ্ত


শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

লোকটা সর্বদা যেন আমাকে তাড়া করছে। ব্যাপারটা ভীষণ বোকা বোকা, কিন্তু সত্যি। লোকটা  কে এবং কি? আমি জানি আমার ভীরু কল্পনা, আমার আতঙ্ক আর উদ্বেগ ছাড়া তার কোনো অস্তিত্ব নেই। তবু- সে টুকুই যথেষ্ট! ...
আমার চিন্তায় সে রয়েই গেছে। সে অদৃশ্য হয়ে থাকে, কিন্তু তার থাকাটা তাতে আটকায় না। সে থাকে দরজার পেছনে, বন্ধ করে রাখা দেরাজ- আলমারিতে, পোশাকের আলমারিতে, খাটের তলায়, ঘরের প্রতিটি অন্ধকার কোণে। আমি যদি দরজা বা দেরাজ-আলমারিটা খুলি, মোমবাতি হাতে নিয়ে খাটের তলাটা খুঁজে দেখি অথবা অন্ধকার জায়গাগুলোতে আলো ছড়াই- তাহলে সে আর থাকে না। কিন্তু আমি অনুভব করি, সে আমার পেছনটিতেই রয়েছে। আমি ঘুরে তাকাই অথচ নিশ্চিতভাবে জানি, তাকে আমি দেখতে পাবো না, কোনোদিনও না। তবু তা সত্ত্বেও, সে আছে- আমার পেছনেই আছে।
ব্যাপারটা ভীষণ অর্থহীন, অথচ ভয়ংকর। কিন্তু আমি-ই বা কি করবো? আমার যে কিছুই করার নেই!
কিন্তু যদি আমরা দুজন মিলে এখানে থাকি, তবে সে আর থাকবে না। আমি একা বলেই সে আছে- স্রেফ আমি একা বলে।
[উৎস: নির্জনে একা // গী দ্য মপাসাঁ // অনুবাদ: দিব্যেন্দ্যু বন্দ্যোপাধ্যায়। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]


২.

শৈশবে ঘুরে বেড়িয়েছি বইয়ের জগতে, আর যৌবনকে ক্ষয় করেছি দিবা স্বপ্ন দেখে। এটা বিশেষ করে উল্লেখ করার মতো কোনও কথা নয়। কিন্তু বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য কথা হলো—বছরের পর বছর কেটে গেল, যৌবনের মধ্য গগনে পৌঁছেও আমি পিতৃপুরুষের এই প্রাসাদেই রয়ে গেলাম—আশ্চর্যের কথা হলো, আমার সাধারণ চিন্তাভাবনাগুলিও কী রকম আমূল বদলে গেলো। পৃথিবীর যা কিছু বাস্তব সব আমার চোখে দেখা দিল স্বপ্ন হয়ে, আর স্বপ্ন-রাজ্যের অসংযত ধারণাগুলি হয়ে উঠল আমার দৈনন্দিন জীবনের মাল-মশলা শুধু নয়, প্রকৃতপক্ষে আমার একমাত্র ও একান্ত অস্তিত্ব।
[উৎস: বেরেনিস // এডগার অ্যালান পো // অনুবাদ: মণীন্দ্র দত্ত। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]


৩.

আমাদের চেনাশোনা, ভালোবাসা হবার আগেই মা যখন মারা গেলেন তখন তাঁর বয়স উনিশ বছর, আর আমার দশ মাস মায়ের এই অসমাপ্ত জীবন বা আমার জীবন থেকে তাঁর এই চিরঅপসরণ একটা প্রাকৃতিক ঘটনামাত্র কিন্তু জন্মমৃত্যুর সঙ্গে স্ত্রীজাতির একটা অতি গ্রহণ যোগ আছে, অতএব পড়শী কুটুম্ব স্ত্রীলোকেরা আমাকে সামনে দাঁড় করিয়ে নিরীক্ষণ করতে করতে সখেদে বলতেন, ‘হায়, পোড়াকপালিয়া, জন্মাইয়াই মায়রে খাইছ!’ অপেক্ষাকৃত তরুণীরা ভুরুতে দুঃখ এঁকে বলত, ‘আহা অর মা নাই।’ কাকে খেয়েছি? কে নেই? - এসব কথায় প্রথমদিকে আমার একধরনের নির্বোধ অস্বস্তি হত কিন্তু ক্রমাগত শুনতে শুনতে শেষে, যে নেই তার না থাকার জন্য একটা আবছা কুয়াশাভরা অপরাধ ভিতরে ছায়া ঘনিয়ে আনত। মনে হত, কোনো দুর্গম কারণে সংসারে আমি অস্বাভাবিক, এবং একা
এই নকল দুঃখই বোধ হয় আত্মকরুণা। দুষ্টুমি করে মারধর খেলে আমি ঐ দুঃখকে খুঁজতে বেরুতাম মুখখানা ম্লান ম্লান করে একা একা ঘুরতাম খালপাড়ে অথবা উঁচু ঢিবির উপর বিশাল শিরীষ গাছের তলায় যেখানে কেউ যায় না সেখান থেকে দেখতাম, দিগন্তে মেঘের মধ্যে কি যেন ঘনিয়ে উঠছে আমি মুখ নিচু করে দুঃখকে খুঁজতাম, মাটিতে কোথায় সে গেঁথে আছে ভাঙা সবুজ বোতলের টুকরো হয়ে
অবশেষে সহজাত পুরুষসংস্কার আমাকে একদিন বলল, এই জোলো হাওয়া ভালো না তার পর থেকে স্ত্রীলোকেদের ঐসব অহেতুক বাষ্পীয় মন্তব্যের সামনে পড়লে - কুমোরের ঘুরন্ত চাকায় একতাল মাটি যেমন আঙুলের চাপে টলতে টলতে শীর্ণ হয়ে ওঠে শূন্যের দিকে তেমনি - কাঁচা শরীরের মধ্যে আমার স্নায়ুরগুচ্ছের নাল লম্বা হয়ে হয়ে মাথা নীলের দিকে উঠত এতকাল পরে এখন জানি, আসলে সুখও নেই, দুঃখও নেই সংসার-সমাজের এজেন্সিগুলো আমাদের মধ্যে সুখ ও দুঃখের ধারণা জন্মিয়ে দেয়, যে ব্যথা ভোগ করার নয় সেই ব্যথা ভোগ করায়
পরে, একটু বড় হয়ে, যেদিন মা'র ছবি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, তাঁকে একমুহূর্তেই প্রত্যাখ্যান করলাম সোজা দাঁড়ানো একটি ছিপছিপে কিশোরী, নাকে পাথর বাঁধানো নোলক। মাতৃত্ব  দূরের কথা, তার ঠোঁটে চোখে চিবুকে তখনো নারীত্বই আসে নি এই আমার মা! তবু একসময় হয়তো তাকে আমার দরকার ছিল কিন্তু এখন, এই পঞ্চান্ন বছর বয়সে যদি সে আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়, হয়তো তাকে বলব – বসো, একটু কিছু খাও – বিস্কুট, সন্দেশ? পারো তো আমার কাঁচাপাকা চুলে একটু বিলি কেটে দাও যাবার সময় দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে যেয়ো। তুমি গতজন্মে আমার মা ছিলে

 [উৎস: অক্ষয় মালবেরি // মণীন্দ্র গুপ্ত। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]


তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি সৌমনা দাশগুপ্ত লিখলেন


আয়না লেখা ঘর  

১.
আলমারির এই চাবিনিরপেক্ষ দেরাজে আলো নেই, অন্ধকারও নেই। 
আত্মনিরোধের রশি দেয়াল টাঙিয়ে দিচ্ছে তুমি এবং তুমির মধ্যে। 
দৌড়ে চলে গেল কয়েকটা ধাঁধা মশকরা, বাদামি ইয়ার্কিতে ঢেকে যাচ্ছে চোখ। 
আর খোলা ভেঙে শাঁস বের করে আনতে আনতে কেউ একটা ঘেমে উঠল। তুমি অথবা তোমার  চাইতেও তীব্র ওপেক কোনও ছায়ার এই সুচ তোমার পিঠের ওপর কাঁথাস্টিচের ফোঁড় তুলেই যাচ্ছে। কফিনের ভেতর যাকে বন্ধ করে রেখেছ, সে তো শুধু গলার স্বর। 
বিজ্ঞাপনের পাতায় কেন যে পিয়ানোর সন্ধানে এত ছানবিন, এত পুঁছতাছ! বরং ছেড়ে দাও একটা বেড়াল। বরং সে-ই খুবলে তুলুক দু-চারটে আঁশ। ছবির থেকে পিছলে যাচ্ছ তুমি, আর দেয়াল খুঁড়তে খুঁড়তে পিছলে যাচ্ছে শাবল। শুধু ঘুমের ভেতর একটা হাওয়া ঢুকে যাচ্ছে, আর অতিজাগরণের এই গুগলি খেলতে গিয়ে তোমার ব্যাট শূন্য থেকে টেনে নামাচ্ছে অম্লবৃষ্টি, অথচ তুমি বোধহয় জানতেও পারোনি, এতদিন তোমার গায়ের সঙ্গে সেঁটে যে দঁড়িয়েছিল, যাকে খুলতে খুলতে তুমি গুঁড়োগুঁড়ো করে ফেলেছ পিলসুজ থেকে পিচকারি অব্দি, সেও সম্ভবত তুমিই ছিলে 


২.
প্রত্নযাজকেরা আসে। তার সব পেঁচার অংশে জাত। আসলে কাছিমের এই এত বছর বেঁচে থাকা এও এক ভাস্কর্য্য। ধরে নিতে পারো এও কোনও ঘরবাড়ি, তুমিও তোমার খোলসের ভেতরে জাগিয়ে রাখছ বিস্তৃত সাপের কাহিনি, এও কী আরেকটা ভাস্কর্য নয়! এই অ্যাসিটিলিন ভর্তি মগজ আর ধুলো ওড়াবার রেওয়াজ নিয়ে কয়েকটা ইনিংস খেলে দেওয়াই যেতে পারে, শুধু ছেনি ও বাটালির এই ধাক্কায় তোমার ঘুমের মধ্যে বেমক্কা ঢুকে যাচ্ছে একটা স্পটলাগা আয়না, একটা অস্থির রাস্তা আর কিছু ডাংগুলি। 
আর জানলা ভেঙে যাচ্ছে, অথবা এই সিনে কোনও জানলা নাই থাকতে পারে। শুধু লংশটে ক্যামেরা প্যান করা হচ্ছে তোমার আগের জন্মের হাসিগুলোর ওপর।  
ক্লোজশট। একটা চোখ। টকটকে লাল একটা কর্ণিয়া। সাদা একটা পাখি চোখের থেকে বেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে......হাত-পা দুমড়ে পড়ে যাচ্ছে একটা ল্যাম্পপোস্ট। নেপথ্যে হড়কা বানের তোড়ে ভেসে যাওয়া গাছেদের চিৎকার 



৩.
গড়িয়ে যাচ্ছে ধারাবাহিক হাততালি
চামড়ার ভেতর হেসে উঠল ভ্রান্ত বাদুড়
ফেড আউট হয়ে যাচ্ছে পাখি। এইমাত্র চোয়াল বুজিয়ে ফেলল খয়েরি একটা লোকগল্পের ঠোঁট
আর আলজিভ খুলে রাখা কয়েকটা স্বপ্ন এখন প্রার্থনা সংগীত শুরু করবে বলে সি মেজরে চিৎকার করে উঠছে একটা অর্গ্যান।
নীল সাদা জামা পরা একটা স্বপ্ন লাইন থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। 
জেলেনৌকার থেকে একদলা আগুন ভাটিয়ালি গাইতে গাইতে দেখো এসে বসে পড়ল এই বিছানায়, ঠিক তোমার মাথার রিমে। 
এই ঘরে দেয়াল দেবে কি দেবে না, সেটা অবশ্যই তোমার অতিব্যক্তিগত ব্যাপার। শুধু যবনিকা টাঙিয়ে দিতে দিতে তোমার হাত ভিজে যাচ্ছে, আর ঘটমান বর্তমানের ভেতর ঢুকে যাচ্ছে একটা শীতকাল। যদিও শীতকাল আমাদের অল্পই, তবুও এই বালির কার্পেটে তাকে বিছিয়ে দিতে গিয়ে দেখতে পাচ্ছ, ফ্লোরস্পেসও আমাদের অল্পই। 
ভবিষ্যকাল আর এনলার্জড হৃদয় নিয়ে একটা পেজমার্কার আকাশের দিকে চলে গেল। তুমি আর ছেড়ে রেখে আসা পৃষ্ঠায় ফিরতে পারছ না   



৪.
তোমার মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। তুমি দেখতে পাচ্ছ তোমার মৃতদেহ ভেসে যাচ্ছে। 
এখানে জল কিম্বা বাতাস সম্পর্কিত কোনও পরিতাপ নেই। শুধু একটা রুমাল বারবার অযাচিতভাবে দৃশ্যের ঘাম মুছিয়ে দিচ্ছে।
আর সাদারঙের ওপর থিসিস তৈরি করতে করতে সেই জাদুকর তোমাকে শোকের গল্প বলেছিলেন, বলেছিলেন, সব রংই বস্তুত সাদা। আর এখন থেকে তোমার জন্য তৈরি করা হবে সেই ধাতব চোখ, যা পরে ফেলার পর প্রজাপতি কিম্বা লোধ্ররেণু বিষয়ক সমস্ত সংশয় তোমার কেটে যাবে।
এরপর শূন্যে আঁকশি দুলিয়ে তুমি অনায়াসেই পেড়ে আনতে পারবে সেই চমকিত আম।  আরও একটু জুম করে দেখলেই দেখতে পাবে, তোমার খুলি পড়ে আছে, একটা বালির জিভ বারবার তাকে চেটে দিচ্ছে। 

রক্তশূন্য এই দিনগুলোতেও লালাবাই শুনিয়ে শুনিয়ে তুমি চেপে রাখতে পারবে সেই বিস্ফোরক অক্ষরগুলিকে, একদিন যাদের ছেড়ে দিয়েছিলে অতিবাতাসের লগ্নে, তারাই মগ্ন কবুতর হয়ে ফিরে এসে তোমার হাত থেকেই খুঁটে খুঁটে দানা খেয়ে যাবে।  

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

2 comments:

  1. "ভবিষ্যকাল আর এনলার্জড হৃদয় নিয়ে একটা পেজমার্কার আকাশের দিকে চলে গেল। তুমি আর ছেড়ে রেখে আসা পৃষ্ঠায় ফিরতে পারছ না"
    মুগ্ধতা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ধন্যবাদ, আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য।

      Delete