জয়দীপ মৈত্র



শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

আমি কি লিখিতে চাই! একটি শুদ্ধ সংখ্যা নৈতিকতার কর্ত্তা ও কর্ম generalization. একজন একজনকে হত্যা করিল। প্রতিজ্ঞা। উহার কারণ যাবৎ না হদিশ হয়, যে মানুষ, বহু সভ্যতাকে আপন রক্ত দিয়া পচাইয়াছে, সে অস্থির, তাহার চেতনা নিশ্চল, এখানেই তাহার মনোবৃত্তিতে ঘষা লাগিতেছে, ফুল ফল বৃক্ষ বনরাজি সমুদ্র তাহার পশ্চাতে সে দেখিল --- এবং সে তাহার শতাব্দীকে, নিজ সময়কে বিবেকহীন বলিতে বারম্বারই চারিদিকে চাহিয়া থাকে --- কেহ তাহাকে লক্ষ্য করিতে আছে কি না! যুক্তি বিবেচনা ---  এক চাবুকেই খরা জমি মাতৃকল্পনা বিরহিত; বালুকায় তরঙ্গ রেখা থাকিলে, নাই যখন তখন তাহা অচেনা, তখনই সেখানে নতজানু হওয়া স্বাভাবিক। বৃত্তিকে কারণ-চালিত করা হইয়াছে; বৃত্তি যেক্ষণে নির্দ্দিষ্ট কারণ মানিল না, তখনই সে লোক মানিল না, চুক্তি ভাঙ্গিল! সকলেই একি-একি! বলিয়া উঠিল! বিধান সমস্বরে কহিল, তুমি বিধিবদ্ধ অন্যায় কর --- অর্থাৎ অন্যায়ের সঙ্গত কারণ প্রয়োজন।
 [উৎস: দিনলিপি // কমলকুমার মজুমদার গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]

২.

জরৎকারুও জানেন, তাঁর কর্তব্য কি, সংকল্প কি? যাযাবর পিতৃসমাজের কাছে প্রদত্ত তাঁর প্রতিশ্রুতি শুধু রক্ষা করতে হবে। অস্তিকা নামে এই নাগরাজ-ভগিনী শুধু পুত্রবতী হবে; এক তরুণীর জীবনে মাত্র এইটুকু পরিণতি সফল করবার প্রয়াস ছাড়া আর কোন অভীপ্সা তাঁর নেই। সংকল্প অনুসারে এই বিবাহিত জীবনকে যেভাবে গ্রহণ করা উচিত, জরৎকারু ঠিক সেইভাবেই গ্রহণ করলেন। কুলরক্ষার আগ্রহ ছাড়া তাঁর মনে আর কোন আগ্রহ নেই।

মমতা এখানে নিষিদ্ধ, অনুরাগ অপ্রার্থিত, হৃদয়ের বিনিময় অবৈধ। স্পৃহাহীন সম্ভোগ, কামনাহীন মিলন। জরৎকারুর প্রয়োজন শুধু অস্তিকার এই নারীশরীর, নারীত্ব নয়। বিবাহের পর জরৎকারু নিরন্তর এবং প্রতি মুহূর্ত অস্তিকাকে বক্ষোলগ্ন করতে চান, বক্ষোলগ্ন ক'রে রাখেন।
 [উৎস: জরৎকারু ও অস্তিকা // সুবোধ ঘোষ। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]

৩.

তথাপি কীর্ত্তনের ধ্বনিমধ্যে কোন আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা নাই, তৎসহ গম্ভীর কণ্ঠে 'গঙ্গা নারায়ণ ব্রহ্ম' আবৃত্তি- উচ্চারণের ভীতিপ্রদ রেশ অদ্য সকালের স্বর্ণাভ তীক্ষ্ণ রৌদ্রে খেলনার মতো নিরীহ। আর যে সমবেত জনমণ্ডলীর চোখেমুখে- যাঁহারা আসীন তাঁহাদের মুখমণ্ডলে- কেশে, ভস্মকণা যায়,  অনিবার্য্যতাকে লইয়া ইহারা প্রহর জাগিয়াছে, ভূতপূজকদের মত ইহারা একনিষ্ঠ বিশ্বাসী; গ্রন্থি নির্ম্মাণের মধুর, সুচতুর, মনোরমা, দিব্য, ছবিলা, চারুকলা-সুকুমার কৌশলখানি মহা ঘোরে বিমোহিত আচ্ছন্ন, ইহা সত্ত্বেও এই মরজগত হইতে অতীব প্রাচীন যে বীজময় শরীর তাহা নির্লজ্জ উন্মুখ, মৃত্যু মৃত্যু মৃত্যুকে তাহা নিতান্ত অবহেলায় চপলমতি বালকের মত তুড়ি মারিতেছিল; প্রত্যেকের মনে ইদানিং বাস্তবতাকে শ্মশানের ক্ষিপ্রতাকে অগ্রাহ্য করত আপন আপন গৃহকোণের প্রতিচ্ছবি চিত্রিত হইয়াছিল।

 [উৎস: অন্তর্জলী যাত্রা // কমলকুমার মজুমদার গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]


তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি জয়দীপ মৈত্র লিখলেন

১.
দুঃখ হয়তো অতিবেগুনি রং
সাদা ফুল তাই রাতে ফুটে ওঠে

তখন একেকটা গাছ
বহুদূর কাঁদলে মনে হয় নক্ষত্র

তাকে ঘিরে আমাদের মানমন্দির
প্রজাপতি ওড়ে

যেন আলো আসার কোন সাদা ফল নেই


২.
কোথাও জল পড়ে দিগন্তে 
কান্নার গাছ ঝাপসা হয়ে আসে 

ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি দুটো আয়না
মুখোমুখি ঝুলছে সেখানে  

অথচ একটাই কাচ তাদের

অন্ধের মুখই একমাত্র কাচ নয় 


৩.
শ্মশানে এসেও অপেক্ষা করানো থেকে
বরফের বিবেক শুরু 

বহু ভ্রান্ত এই মৃতদেহ
কাছের মানুষ শেষবারও দেখতে পেলো না

দূরের লবণই তার ধর্ম


৪.
শালকাঠে বানানো জানালা দিয়ে 
শালবনের হাওয়া আসছে

গাছের ভেতরেই গাছটির দোষ দেওয়া রইলো

গাছের তো দোষ নেই

এটুকু আলাদা করতেই পারে ঘুণপোকা


৫.
তোমাকে স্মরণ কোরো

আমি খুব চেনা কারো মৃতদেহ

নীরবতা পালনের মাঝে
অচেনা শিশুর চিৎকারের মতো 


৬.
অনেকক্ষণ সূর্যের দিকে
একটানা তাকালে কালো লাগে

যে কারণে গর্ভবতী উট 
মরুভূমির মধ্যে আঁকা হলো না

এই মরীচিকা
তখনও কালো রং না দেওয়ার মা                                                          


৭.
কে আগে এসেছে 
খুঁজতে খুঁজতে সবাই সবাইকে নকল করছে 

তোমার সাথে দেখা হবেনা ভেবে বানালাম
আমাদের এই ঘর

ঘরের কারণগুলি একদম আসলের মতো  


৮.
রক্তের দাগ আর রক্তের পেছনে নেই 

হত্যা আসলে টিকটিকির আশ্রম 

পোকাটি সচল ছিলো বলেই
দেয়ালের রং ভুলে গেছি

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

2 comments:

  1. আহা জানি না এসব কবিতার উঠোনে কোনও গদ্যের চৌকাঠ রাখা যায় কিনা। কিনারা ভেঙে গেছে জয়দীপের কলমে আহা যতবার পড়ি নিজস্ব দিগন্ত উঠে আসে দ্যাখার গভীরে দর্শন ঝলসে ওঠে

    লেখ জয়দীপ লেখা ... লিখে যা ভাই

    ReplyDelete
    Replies
    1. সত্যিই। আমরা চাই জয়দীপ মৈত্র আরও আরও লিখুন। আমরা উনার লেখার অপেক্ষায় থাকবো।

      ধন্যবাদ আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য।

      Delete