আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম
১.
মাসিমা
জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘সব জিনিস উঠেছে তো? আমি এক দুই করিয়া গনিয়া বলিলাম, হ্যাঁ, মোট
বাইশটি মাল উঠিয়াছে। নিমেষে মাসিমার চোখে জল আসিল। আমিও অপ্রস্তুতের এক শেষ।
বুঝিতে পারিলাম নিজের অজ্ঞানতায় কোনো অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছি। পরে মাসিমা তাহা
পরিষ্কার করিয়া বলিয়া দিলেন...রেশমী কাপড় দিয়া ঢাকা তাঁহার স্বর্গীয় গুরুদেবের
তৈল-চিত্রটিকে আমি ‘মালে’র মধ্যে গণিয়াছি। সেই সময় মাসিমার এই মনস্তত্ব আমার নিকট
অদ্ভুত মনে হইয়াছিল, -- আর আজ আসামী কথাটি শুনিবার পর নিজের চিন্তাধারা দেখিয়া
আশ্চর্য হইয়া যাইতেছি। ফাঁসির আসামীকে আসামী না বলিলেই আশ্চর্য হইবার কথা। ফাঁসির
মঞ্চ কথাটিকেও যেন কত শহীদের স্মৃতির সুবাস ঘিরিয়া আছে; কিন্তু উহাকেই ‘ফাঁসিকাঠ’
বলো মনে পড়িবে খুনী আসামীর কথা। আর সব চাইতে আশ্চর্য, মানসনেত্রে দেখি একটি মৃতদেহ জিমনাষ্টিকের হরাইজ্যান্টাল
বারে ঝুলিতেছে- অসাড় পা দুখানি শূন্যে ঘুরপাক খাইয়া দুলিতেছে- ধীরে একঘেয়ে গতিতে,-
উত্তর, উত্তরপূর্ব, পূর্ব, পূর্বদক্ষিণ, দক্ষিণ, দক্ষিণপশ্চিম, দক্ষিণ,
পূর্বদক্ষিণ, পূর্ব, উত্তরপূর্ব, উত্তর- কোনো ইংরাজী নভেলে পড়া একটি দৃশ্য...।
[উৎস: জাগরী // সতীনাথ ভাদুড়ি। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
২.
যুধিষ্ঠির বলছেন- “ন্যায়ানুসারে আমরা সম্পত্তির
অনধিকারী নহি। কৌরবগণকে সংহার করিয়া রাজ্য লাভ করিলে রৌদ্র (বীভৎস) কর্মের
পরাকাষ্ঠা প্রদর্শণ করা হয়। জ্ঞাতিবর্গের কথা দূরে থাকুক, যাহারা বান্ধব নহে, অথচ
সতত অভদ্রতা ও শত্রুতা করে, তাহাদিগকেও বিনাশ করা কর্তব্য নহে। অতএব যুদ্ধ করিয়া
কৌরবদিগকে বধ করা নিতান্ত পাপকর। ক্ষত্রিয় ধর্ম পাপজনক। যুদ্ধে জীবিত (যাপন) বা
মরণ লোকের ইচ্ছানুসারে হয় না।...
আরো বলছেন- মৃত ব্যক্তির জয় পরাজয় সমান। জীবিত
ব্যক্তির পরাজয়ও মৃত্যু হইতে বিশেষ নহে। জয়লাভও পরাজয়ের তুল্য। কেন না, উহাতে অন্য
কর্তৃক অনেক দয়িত (প্রিয়) ব্যক্তির প্রাণ সংহার হইয়া থাকে। অনাত্মীয় ব্যক্তিগণকে
সংহার করিলেও অতিশয় অনুতাপ উপস্থিত হইয়া থাকে।
শত্রকুলে
এক ব্যক্তি জীবিত থাকিলেও পুরাতন বৈরের উল্লেখ হইতে থাকে। বৈর কদাচ বৈর দ্বারা
প্রশমিত হইবার নহে। এ স্থলে সন্ধিস্থাপনপূর্বক আমাদের উভয় পক্ষেরই সমুচিত স্ব স্ব
অংশ প্রাপ্ত হইয়া শান্তি লাভ করাই শ্রেয়। শান্তির চেষ্টা বিফল হইলে অগত্যা যুদ্ধ
করিতে হয়।
[উৎস: মহাভারত // বেদব্যাস // অনুবাদ: কালীপ্রসন্ন সিংহ। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
৩.
আকাশে
নক্ষত্র ফোটে; পৃথিবীতে ফুল ফোটে। নক্ষত্র অন্ধকারের ভিতর দিয়া ফুল দেখিয়া বলে, তুই ফুটিস
বলিয়া আমি ফুটি; ফুল অন্ধকারের ভিতর দিয়া নক্ষত্র দেখিয়া বলে, তুই ফুটিস বলিয়া
আমি ফুটি। আকাশ বিশ্বের
আধখানা; পৃথিবী বিশ্বের আর আধখানা। তাই
বলি যখন আকাশে নক্ষত্র ফোটে আর পৃথিবীতে ফুল ফোটে, তখন আর আধাআধি ভাব থাকে না। তখন বিশ্বের উপরার্ধ এবং বিশ্বের
নিম্নার্ধ মিশিয়া এক হইয়া যায়।
ফুলের ডোরে উপর-নীচে বাঁধা।
আবার
ফুলের ডোরে নীচে সব বাঁধা। এখানেও ফুল আর নক্ষত্র একই বস্তু, কেন না নক্ষত্রের
কিরণ ডোরেও নীচে সব বাঁধা। একটু ভাবিয়া দেখ। মনুষ্যের ইতিহাসের যুগযুগান্তরের পিছনে গিয়া দাঁড়াও।
ইংলন্ড, ফ্রান্স, জার্মানি ভুলিয়া যাও; গ্রীস রোম পারস্য ভুলিয়া যাও; তাজমহল,
পার্থিনন, ভুবনেশ্বর, কোনারক ভুলিয়া যাও। সব
ভুলিয়া সভ্যতাবিহীন, শাস্ত্রবিহীন, ইতিহাসবিহীন, অন্নবস্ত্রবিহীন কালুদীয়
মেষপালকদিগের মধ্যে গিয়া দেখ তাহারা কি করিতেছে। দেখিবে তাহারা দিনে ভেড়া চড়াইতেছে, রাত্রে নক্ষত্র
ভাবিতেছে। অথবা গো-মহিষ
সম্বল ভারতীয় আদিম আর্যগণের মধ্যে গিয়া দেখ, তাহারা কি করিতেছে। দেখিবে তাহারা দিনে গো-ধন বাড়াইবার
জন্য কত গব্য-কাষ্ঠ জ্বালাইতেছে, রাত্রে আকাশে সপ্তর্ষি দেখিয়া সাধের গো-ধন
পর্যন্ত ভুলিয়া যাইতেছে। তারপর সেই
আদিমকাল হইতে ক্রমে ক্রমে অগ্রসর হও।
হইয়া ঊনবিংশ শতাব্দীতে প্রবেশ কর।
বরাবর দেখিবে মানুষের এক চক্ষু পৃথিবীর জিনিসে আর এক চক্ষু আকাশের নক্ষত্রে।
নক্ষত্র মনুষ্যের চিরন্তন চিন্তা, আবহমান আকাঙ্ক্ষা, গূঢ়নিহিত কৌতূহল! আবার পিছাইয়া
যাও- সোনা, রুপা, মণি, মুক্তা, বস্ত্র, অলংকার, গৃহ অট্টালিকা, অর্ণবযান,
বাষ্পীয়যান প্রভৃতি সমস্ত বাহ্য সম্পদ এবং সভ্যতাসূচক বস্তু ভুলিয়া, আদিম
মহারণ্যে প্রবেশ করিয়া আদিম মনুষ্যকে দেখ। দেখিবে
তোমার যাহা আছে তাহার সে সব কিছুই নাই। কেবল তোমার যে ফুলটি আছে তাহারও সেই ফুলটি
আছে। তারপর ক্রমে অগ্রসর হইয়া ঊনবিংশ
শতাব্দীর জেলার মধ্যে প্রবেশ কর।
বরাবর দেখিবে মানুষ সব পরিবর্তন করিতেছে, কিন্তু যে ফুল প্রথমে তুলিয়া পরিয়াছে এখনও সেইফুল তুলিয়া পরিতেছে। ফুল মানুষের চিরন্তন সাধ, আবহমান অনুরাগ, গূঢ়নিহিত
ভাব। তাই বলি যে আকাশের
নীচে ফুলের ডোরে আর নক্ষত্রের কিরণ ডোরে সব বাঁধা। সেই জন্যই বুঝি ঐ দুইটি ডোর
মিশিয়া স্বর্গ-মর্ত্য বাঁধিয়া ফেলিয়াছে।
ফুল! তুমি কি কঠিন। তোমার
কল্পনাতীত কমনীয় কান্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড বাঁধা। তবে বুঝি বাঁধিতে হইলে কমনীয়তা
দ্বারা বাঁধিতে হয়?
[উৎস: ফুলের ভাষা // চন্দ্রনাথ বসু। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]
তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি মেঘ অদিতি লিখলেন
ন হন্যতে
১.
“কর্মণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন
মা কর্মফলহেতুর্ভূমা তে সঙ্গোহস্ত্বকর্মণি “
একটা ‘না’-হয়ে ওঠা প্রাণে আর নির্যাস লাগছে না। একটা
‘হ্যাঁ’-এর ভেতর ঘুমিয়ে পড়ে সম্পর্কে বাজছে না কোনো শঙখ। থেকে থেকে কেবল মার্বেল হয়ে
উঠছে ব্রহ্মাণ্ড।
অর্থ পালটে গেলে ব্যক্তিগত রঙিন দৃশ্যে লাগে রঙহীন
আলবিদা। মুহূর্তে মুহূর্ত জাগে, জেগে ওঠে অন্য দর্পণ।
জলের তলে দুলতে থাকা অবিনাশী এক পেন্ডুলাম দেখতে দেখতে
সামান্য দূরে চকখড়িতে লিখে রাখি, কর্মই প্রকৃত শান্ত দিন..
২.
‘কা তব কান্তা কস্তে পুত্র’
শেষে এই নিভু আলোয় বৃষ্টিও আর সুরেলা হলো না। আর্ত
থেকে মৃত্যু, মৃত থেকে পুনর্জন্মে, মুছে গেল সব সমীকরণ। বহুদূর খুঁড়ে ফেলা গেল জীবন।
সংহারের দিনগুলো থেকে লাভ হলো আপাত কিছু মোক্ষ।
ভাষা থেকে তবু উঠে আসছে এত হুঙ্কার। কিছুতেই আর ধরা
যাচ্ছে না অডিয়্যান্স।
হতে পারত, যত ফুল তত বিস্ময়! নির্বিশেষে
জীবন পৌঁছে যেত গোপন ভালোবাসায়..অথচ দিনগুলো নিভুনিভু হয়েও জ্বলে উঠল না।
যতগুলো মুখ আঁকা হলো তাদের আস্তর সরাতেই স্পষ্ট হলো
হারজিৎ।
৩.
‘অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’
ভাঙা সার্কাসের সন্ধ্যা
জমে উঠবে উঠবে করেও থমকে আছে শেষ দৃশ্যে
শূন্যে উঠে ফের মাটিতেই আছড়ে পড়ল রিংমাস্টার
বিরতিতে-
যন্ত্রণার এইসব দৈর্ঘ্য জুড়ে যে মেরুনরঙা ফাঁস
মোহমুক্তি লেগে তার আলগা হলো জিভ
সন্ধ্যার শেষবিন্দু মিলিয়ে গেলে
যোগে বিয়োগে মৃদু জন্ম নেবে ফুল
হল্লা মুছে সমগ্রে লেখা হবে ইতিহাস
অসীমে কণা কণা ফ্রেম হবে তার আলো
No comments:
Post a Comment