আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম
১.
কোনো
বিশেষ শ্রেণীর লোক দলবদ্ধভাবে কোথাও বাস করলে সে পাড়ার বাতাসে পর্যন্ত তাদের
বৈশিষ্ট্য যে কেমন করে ছড়িয়ে পড়ে আমি বুঝতে পারি না। ছাতাওয়ালা গলির সঙ্গে ডেকার্স
লেনের যে পার্থক্য আছে, তা আমার চোখ বেঁধে দিলেও বলে দিতে পারি। ব্যক্তি-জীবনের
বৈশিষ্ট্যগুলো যে কেন যে গন্ধেও ধরা দেয়
তা বলা শক্ত। এসপ্লানেড-পার্ক সার্কাসের ট্রামটা যখন ওয়েলেসলীর মধ্য দিয়ে এলিয়ট
রোডে ঢুকে পড়লো, তখনও এক ধরনের গন্ধ পেলাম। সত্য কথা বলতে কী, এই গন্ধ কেউ বিশেষ
উপভোগ করেন না।
[উৎস: চৌরঙ্গী // শংকর। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
২.
বর্ধমান
কৃষক সম্মেলন থেকে সেবার লোকাল ট্রেনে ফিরছি, কী মনে করে বনবিহারী ঝালমুড়িঅলা
ছেলেটার কাছে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা ভাই, পূর্ণিমা কবে?’
তখন
বিকেলবেলা। ছেলেটি ভরাভর্তি
শালিমার তেলের কৌটার মধ্যে শিশি থেকে তেল মারা শেষ করে, ঘটরঘটর শব্দ তুলে মুড়ি
মশলা নাড়িয়ে চলল। উত্তর নেই।
বনবিহারী,
পুনরায়- ‘পূর্ণিমা কবে জানো তুমি?’
‘না।’
মুড়ি-ঘাঁটা থামিয়ে হেঁড়ে ঘড়ঘড়ে গলায় ছেলেটি বলল, ‘আমি আকাশ দেখি না।’ এত বলে সে বাইরে গয়ের ফেলে।
এখানে আমার মনে পড়ল সে-কথা। কিন্তু বনবিহারী? তার তো পড়ল না মনে। তার মন থেকে এ-সব মুছে গেছে।
এমনি কত শত ঘটনা যে তার মন থেকে লেপেপুঁছে গেছে
তার ঠিক নেই। যা আমি জানি। কিন্তু বনবিহারী জানে না। আর জানে না।
[উৎস: আমি ও বনবিহারী // সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]
৩.
বাঙালি
পাঠক এখানে একটু বিপদগ্রস্ত হবেন। আমি জানি, বাঙালি - তা তিনি হিন্দুই হন আর
মুসলমানই হন – আরবী ফার্সী মুসলমানি নাম মনে রাখতে বা বানান করতে অল্পবিস্তর কাতর
হয়ে পড়েন। এ কথা জানি
বলেই এতক্ষণ যতদূর সম্ভব কম নাম নিয়েই নাড়াচড়া করেছি - বিশেষত আনাতোল ফ্রাঁসের
মতো গুণী যখন বলেছেন, ‘পাঠকের কাছ থেকে বড্ড বেশি মনোযোগ আশা করো না; আর যদি
মনস্কামনা এই হয় যে, তোমার লেখা শত শত বৎসর পেরিয়ে পরবর্তী যুগে পৌঁছক তা হলে
হাল্কা হয়ে ভ্রমণ করো।’ আমার সে-বাসনা
নেই, কারণ ভাষা এবং শৈলী বাবদে আমার অক্ষমতা সম্বন্ধে আমি যথেষ্ট সচেতন। কাজেই যখন ক্ষমতা নেই, বাসনাও নেই তখন পাঠকের নিকট ঈষৎ মনোযোগ প্রত্যাশা করতে পারি। মৌসুমী ফুলই মনোযোগ চায় বেশি; দু’দিনের
অতিথিকে তোয়াজ করতে মহা কঞ্জুসও রাজি হয়।
[উৎস: দেশে বিদেশে // সৈয়দ মুজতবা আলী। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]
তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি অয়ন্ত ইমরুল লিখলেন
১.
অনন্যা যেখানে ওড়ে,খাঁজকাটা ধু ধু
একটা মউল গাছ
গাছের বাইরে দুলারি —
দুপুর বেলার ঝাপটা পেরোচ্ছি কি না....
আমরা শুনলাম ধানশিলা বিবাহগীতে
অন্ধ কাকতাড়ুয়া—
কি এক গন্ধের ঢেউ ছড়িয়ে হাওয়ায়
পাখি আড়াল তুলে গাছে—
ডেকার্স লেনের শিসপ্রিয়া আজকাল রাণী সেজে থাকে!
আর সার্কাসের তাঁবু ভেদ করে ডোরাকাটা ঘোড়া
আরোও বয়ে যায় কয়েদীর মতো হ্রেষা—
এই হ্রেষায় কাৎ ঘুমের সোনাদানা থাকে
থাকে বায়স্কোপের চাঁদ
নয়নজুলি ডিঙিয়ে উঠে আসে টোপর পানার টিপে
তখন এলিয়ট রোড অথৈ শূন্যতা ঘিরে ডাকছে কৃষ্ণচূড়া
আর কৃষ্ণক্রান্ত ছায়ায় গজিয়ে উঠছে অসংখ্য কালো মাথার বিড়াল....
২.
নদীতে বাঁক নেই
বাঁকে নদী আছে
নদীতে ডুব দিলেই বনবিহারি তুলে আনে
দশপায়ি লাল কাঁকড়া
এই দেখে,টিলিক দেয় চরবাউলের মেয়ে
তবু খোপা থেকে খসে না পালিত রক্তজবা
অথচ টিলিক দিলে একটা বড় ঝাঁকির শব্দ হওয়ার কথা
বনবিহারির ভাবনার মধ্য দিয়ে একটা পূর্ণিমা উবুড় হয়
একটা রাতকানা রাতের রাইয়ের দিকে কিনা
স্খলন গুঞ্জনে ফোটে নাগকেশর তার মনে
—কখনও ভুলেও পড়বে না মৃত কসুমের গন্ধে চারিদিকে এত প্রকৃতি....
৩.
একটা দাগ রেখে যেতে চাই
আর কিছু না
এই ধরো ডেউয়ায় শালিখের ঠোকর
কিংবা নদীর রেখার মতো
রাধের কাছেও একটা দাগ ছিল
ওটা বেশ বড়
আমি সামান্য দাগ রাখতে চাই
যেমন সাদা পাঞ্জাবিতে ফোটে ওঠা তিল
হলুদ পাতার গোল গোল কালো ছাপ
ভাষা আর শৈলী বাবদ যদি কিছু পাও
ওই টুনটুনের তিড়িং
বহু দূর ওড়ে আসা অয়নচিলের ডানা
তার রশ্মির ঢেউ
প্রেম রিহার্সেল করো জপমালার ঘ্রাণ ধরে
No comments:
Post a Comment