জ্যোতির্ময় মুখার্জি



শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

রাতের অন্ধকার নামলে শারিবা পাতালু নদীর দিকে চলতে শুরু করে। আজ আকাশে চাঁদ আছে। পৃথিবী রহস্যময়। অনেকক্ষন নদীর পাড়ে সে একা বসে থাকে। তারপর একসময় ফিরবার জন্য সে উঠে দাঁড়ায়, তারপর অন্যকিছু চিন্তা করে গ্রামে ফেরার বদলে নদীর বাঁওড়ের দিকে এগোয়।
নিস্তব্ধ বাঁওড়ের চারপাশে একমাত্র হাওয়ার শব্দ। চাঁদের আলোয় দীর্ঘ গাছ এবং নিচের ঝোপঝাড়ে আলোছায়ার লুকোচুরি। নদীর পাড় থেকে ঘাসের জঙ্গল উঠে গেছে একদিকে। আধামানুষ সমান ঘাসের জঙ্গল। সেখানে সঞ্চরণশীল ছায়ার দিকে শারিবা একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে। লুবিনি এই ছায়ার মধ্যে ঢুকে বসে আছে। এখন সে ভাবে, তবে কি রহু তৃপ্ত? বাজিকরদের আর কিছু না হোক স্থিতি হয়েছে। আর কোনো বাজিকর কোনোদিন এই গ্রাম ছেড়ে নতুন করে রাস্তায় বেরোবার কথা ভাববে না। এখন তার যা কিছু ভাবনা তা এই দরিদ্র হতশ্রী কুঁড়েঘরগুলোকে কেন্দ্র করে, এতে শারিবার আর কোনও সংশয় থাকে না। কিন্তু শারিবার রক্তের অস্থিরতা কাটে না কেন? কেন লুবিনির কাঁপা কাঁপা হাত তাকে এখনো অনেক কিছু দেখাতে চায়? সে আলোছায়ার দিকে তাকিয়ে পীতেমের মার খাওয়া দেখে, পেমার আর্তনাদ শোনে, নমনকুড়ির বন্যার জল ক্রমশ বেড়ে উঠে সর্বনাশ হতে দেখে, নৌকার গলুইয়ের উপর রক্তাক্ত জামিরকে দেখে। সে দেখে লুবিনিকে ধর্ষিতা হতে, হাতির পায়ের চাপে ঘর ভাঙছে, শিশু মরছে। পলায়নপর বাজিকর গোষ্ঠীকে সে দেখে জল কাদা ভেঙে পাতালু নদীর তীর ঘেঁষে ছুটতে। সে দেখে সেই ভীবৎস রাত, যখন তার ভাই সাপের কামড়ে মারা যায়। আরো কত জানা অজানা দৃশ্য সে সম্মোহিতের মতো দেখে। তারপর সবশেষে ওমরের ছিন্ন মুণ্ডু যখন আকাশপথে তার দিকে ছুটে আসতে থাকে তখন সে হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে পড়ে। দু-হাতে মুখ ঢেকেও রেহাই পায় না সে। ওমরকে সে বলতে শোনে, শারিবা তুই হামাক্ বাচাবু বলিছিলি!
[উৎস: রহু চন্ডালের হাড় // অভিজিৎ সেন। গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা]

 ২.
প্রায় একভাবে কিছুই যায় নাযেমন মনেতে রাগ চাপা থাকিলে একবার না একবার অবশ্যই প্রকাশ পায় তেমনি বড়ো গ্রীষ্ম ও বাতাস বন্ধ হইলে প্রায় ঝড় হইয়া থাকে। সূর্য অস্ত যাইতেছে সন্ধ্যার আগমন দেখিতে দেখিতে পশ্চিমে একটা কালো মেঘ উঠিল দুই-এক লহমার মধ্যেই চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার হইয়া আসিল হু-হু করিয়া ঝড় বহিতে লাগিল কোলের মানুষ দেখা যায় না সামাল সামাল ডাক পড়ে গেল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ চম্‌কিতে আরম্ভ হইল ও মুহুর্মুহুঃ মুহুর্মুহুঃ বজ্রের ঝঞ্জন কড়মড় হড়মড় শব্দে সকলের ত্রাস হইতে লাগিল বৃষ্টির ঝরঝর তড়তড়িতে কার সাধ্য বাহিরে দাঁড়ায়। ঢেউগুলা এক একবার বেগে উচ্চ হইয়া উঠে আবার নৌকার উপর ধপাস্ ধপাস্ করিয়া পড়ে। অল্পক্ষণের মধ্যে দুই-তিনখানা নৌকা মারা গেল। ইহা দেখিয়া অন্য নৌকার মাঝিরা কিনারায় ভিড়তে চেষ্টা করিল কিন্তু বাতাসের জোরে অন্য দিগে গিয়া পড়িল। ঠকচাচার বকুনি বন্ধদেখিয়া শুনিয়া জ্ঞানশূন্য তখন এক একবার মালা লইয়া তসবি পড়েন তখন আপনার মহম্মদ, আলী ও সত্যপীরের নাম লইতে লাগিলেন। বাবুরামবাবু অতিশয় ব্যাকুল হইলেন, দুষ্কর্মের সাজা এইখানেই আরম্ভ হয়! দুষ্কর্ম করিলে কাহার মন সুস্থির থাকে? অন্যের কাছে চাতুরীর দ্বারা দুষ্কর্ম ঢাকা হইতে পারে বটে কিন্তু কোনো কর্মই মনের অগোচর থাকে না। পাপী টের পান যেন তাঁহার মনে কেহ ছুঁচ বিঁধছে সর্বদাই আতঙ্ক সর্বদাই ভয় সর্বদাই অসুখমধ্যে মধ্যে যে হাসিটুকু হাসেন সে কেবল দেঁতোর হাসি। বাবুরামবাবু ত্রাসে কাঁদিতে লাগিলেন ও বলিলেনঠকচাচা কি হইবে। দেখিতে পাই অপঘাত মৃত্যু হইল বুঝি আমাদিগের পাপের এই দণ্ড। হায় হায় ছেলেকে খালাস করিয়া আনিলাম, ইহাকে গৃহিণীর নিকট নিয়ে যাইতে পারিলাম না যদি মরি তো গৃহিণীও শোকে মরিয়া যাইবেন। এখন আমার বেণী ভায়ার কথা স্মরণ হয় বোধ হয় ধর্মপথে থাকিলে ভালো ছিল। ঠকচাচারও ভয় হইয়াছে কিন্তু তিনি পুরানো পাপী মুখে বড়ো দড় বলিলেন ডর কেন করো বাবু? লা ডুবি হইলে মুই তোমাকে কাঁধে করে সেঁতরে লি্য়ে যাব আফদ তো মরদের হয়। ঝড় ক্রমে ক্রমে বাড়িয়া উঠিল নৌকা, টলমল করিয়া ডুবুডুবু হইল, সকলেই আঁকু পাঁকু ও ত্রাহি ত্রাহি করিতে লাগিল, ঠকচাচা মনে মনে কহেন চাচা আপনা বাঁচ
[উৎস: আলালের ঘরের দুলাল // প্যারীচাঁদ মিত্র। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]

 ৩.
এক প্রান্তে স্টেজ...পিছন থেকে বেরিয়ে এল ছটি মেয়ে। গলা থেকে পা অবধি ধবধবে সাদা শেমিজের মতো লম্বা জামা পরা। রাস্তায় মিশরী মেয়েদের এ রকম জামা পরতে দেখেছি। তবে অন্য রঙের।
আস্তে আস্তে তারা স্ফিংক্সের চারদিকে ঘুরে ঘুরে নাচতে আরম্ভ করল। বড় মৃদু পদক্ষেপ। পায়রা যে রকম নিঃশব্দ পদসঞ্চারণে হাঁটে। চাঁদ যে-রকম আকাশের তারার ফুলকে না মাড়িয়ে আকাশের এপার ওপার হয়।
পায়ে ঘুঙুর নেই, হাতে কাঁকন নেই। শুধু থেকে থেকে সমের একটু আগে তেহাইয়ের সময় থেকে বাঁশি, খঞ্জনী আর ঢোলের সামান্য একটুখানি সঙ্গীত। বড় করুণ, আর্ত বিষাদে ভরানীলনদের এপার থেকে মা যেন ওপারের ছেলেকে সন্ধ্যার সময় বাড়ি ফেরার জন্য ডাকছে। এ ডাক আমি বহুবার শুনেছি। যে মা-ই ডাকুক না কেন, আমি যেন সে ডাকে আমার মায়ের গলা শুনতে পাই।
সে ডাক বদলে গেল। এবার শুনতে পাচ্ছি অন্য স্বর। এ যেন মা ছেলেকে ঘুম থেকে জাগাবার চেষ্টা করছে। এ গলায় গোড়ার দিকে ছিল অনুনয়-বিনয়। তার পর  আরম্ভ হল আশা-উদ্দীপনার বাণী। সঙ্গীত জোরালো হয়ে আসছে। পদক্ষেপ দ্রুততর হয়েছে। ছটি নয়। এখন মনে হচ্ছে যেন ষাটটি মেয়ে দ্রুত হতে দ্রুততর লয়ে নৃত্যাঙ্গন অপূর্ব আলিম্পনে পরিপূর্ণ করে দিয়েছে! আর কণামাত্র স্থান নেই।
[উৎস: জলে ডাঙায় // সৈয়দ মুজতবা আলী। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস সাধন দাস]

তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি জ্যোতির্ময় মুখার্জি লিখলেন

একার

মতো স্থির হয়ে থাকে নদী
জলে স্রোত কেঁপে হেঁটে যায় মৃদু
এপার ধরে লম্বা ঘাসের বন
দুই পারে চাঁদ ভেঙে ভেঙে নামে

ওপারে শুধু দীর্ঘ গাছের সারি
দৃশ্যের মতো ওরা দেখেছে যা কিছু পুরনো
দৃশ্যের ভারে মুদে আসে দুই হাঁটু
পায়ের ফাঁকে ছায়া ঘন হয়, ভাঙে

ছায়ার ছায়ায় নেমে আসে শব মুখ
শব্দের মতো ওরা শিষ দিয়ে সব ডাকে


নাচ লেখে

ঢেউ ও মেয়ে
মেঘ ঢেকে দেয় আলো

ছায়ারা ছায়া থেকে নেমে এলে
প্রকৃত শরীরের কাছে এসে বসি


হাওয়ার শব্দে

বাঁওড় খুলে যায়। নদী আদতে একা‌
ছায়ার ভেতর যা কিছু লুকোচুরি
তাকে স্থিতি ভেবে এগিয়ে আসছে কেউ

এখানে মাটি-মানুষে কোনও সম্মোহন নেই
এখানে কাঁপা কাঁপা হাতে বাজিকর

ছিঁড়ে ফেলে তার নিজেরই ইন্দ্রজাল



তুই যে বলেছিলি

আমাকে বাঁচাবি। হতচ্ছাড়া
নিচু স্বরে চিঠি খোলে

নদী লেখে
এক পংক্তি জ‍্যোৎস্না

পড়তে
    পড়তে

ছায়া কথা বলে


পায়ের পাতায়

জল নাচছে
মঞ্চ জুড়ে নেচে চলে সাদা মেয়ে

বিদ‍্যুতের মতো ওরা ঘুরে ঘুরে নাচে

জলের উৎসবে আজ ওরা আগন্তুক
মেঘ, ঝড় ও মেয়ে

একটু একটু করে বেড়ে গেলে দুই পার
ওপার থেকে মা ডাকে


ছায়ার ঠিকানায়

লেখা থাকে কিছু নাম
মঞ্চে ঢেউ তুলে নাচে কিছু মেয়ে

তোমরা কে গো?
কেন নাচো?

দেখছ না, দুর্নাম রটছে নদী-জলে?


আমাকে এভাবে

শাসাচ্ছ কেন
আমাক এভাবে ভয় দেখাচ্ছ কেন?

ডুবে যাব সব নৌকার মতো
ছায়া হয়ে এলে ভারী


অবশেষে নদী বলল

টলতে টলতে আটকে রাখো চাঁদ
টলটলে আলোয় রাত বেড়ে চলে

রাতচরার মতো হেঁটে যায় শারীবা
পাতালু নদীর দুই ধারে ছায়া খসে খসে পড়ে

আর এক পা এগোলেই, মা ডাকে
বাড়ি ফিরে আয় বাছা

আর এক ঘুম ঘুমালেই, মা ডাকে
ওঠ ওঠ, বেলা হয়ে গেল যে

মঞ্চ জুড়ে নাচতে নাচতেই ওরা ঘুমিয়ে পড়ে
ওরা ছমছমে, ঘুর্ণি জলের মেয়ে

ডুবতে ডুবতে কাছি ধরে
মৃত্যু জেগে থাকে

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

3 comments: