আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম
১.
শোভাদি,
আপনার
আমন্ত্রণ-পত্রের জন্য অশেষ ধন্যবাদ।
আপনি জানিয়েছেন এ আমন্ত্রণের উদ্দেশ্য হলো একটি ঘরোয়া জলসায় ও জলপানে গণনাট্য সংঘের
কিছু পুরোনো কর্মীদের একত্রিত করা।
আপনি ‘লিখেছেন মৃত্যু এসে একে একে অনেককেই গ্রাস করছে। আমরা যে কয়জন আছি একটু আনন্দ করি, আসুন।’
কিন্তু শোভাদি, আমাদের পুরোনো সুখী পরিবারের
যাদের মরণ ঘটেছে- তাদের মৃত্যুতে আপনার আমার মনে যে ভাবই জাগুক না কেন, দেশের অগণিত
সংগ্রামী মানুষের কোন ক্ষতি হচ্ছে বলে তো মনে হচ্ছে না। একদিন যারা
প্রগতি শিল্পসাহিত্যের দেউলে প্রদীপ জ্বালিয়েছিলেন
প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী জনগণের পক্ষভুক্তির প্রতিশ্রুতিতে, তারা আজ একে
একে প্রায় সকলেই শাসক ও শোষকের দরবারে উচ্ছিষ্টভোজী কিংবা আত্মসমর্পণের পথে
প্রসাদপ্রার্থী। তাদের জ্বালানো
বাতি নির্বাপিতপ্রায়। আজকের
চণ্ডশক্তির হাতে সেজন্য তারা পুরস্কৃত। এক
হাতে নতমস্তকে সেই পুরস্কারগ্রহণ অন্যহাতে শিল্পকর্মে জনগণের প্রতি অনুকম্পা
বিতরণ- এই দ্বৈত অভিনয়ই তো আজ দেখছি।
জনগণের কাছে এরা অনেক আগেই মৃত।
প্রগতির এই প্রেতনৃত্যে আনন্দ করবো কাদের নিয়ে?
বরঞ্চ আমাকে একটু নিরানন্দে একা থাকতে দিন। আপনার অন্তরঙ্গ আমন্ত্রণ রাখতে পারলাম
না বলে দুঃখিত। আশা
করি মার্জনা করবেন।
হেমাঙ্গ
বিশ্বাস
পুনশ্চঃ
আমার বইটি আপনি পড়েননি এখনো এটা আমারই দুর্ভাগ্য। তবে সব বই সবসময় পড়া যায় না। এতো সময়ই বা আপনার কোথায়? আমার প্রকাশক আমাকে যে-কয়টি
সৌজন্য সংখ্যা দিয়েছিলেন সেগুলো আমার গ্রন্থপ্রণয়নে যারা সাহায্য করেছেন তাদের
দিয়ে দিয়েছি। এখন আমাকেই
কিনতে হয় (অবশ্য কমিশনে) তাই আপনাকে দিতে পারলাম না। তবে দাম তো মাত্র ২০৲ যা আপনার পক্ষে কিছুই
নয়।
[উৎস: চিঠি শোভা সেনকে // উজান গাঙ বাইয়া // হেমাঙ্গ বিশ্বাস। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]
২.
পাশের বাড়ির জানলা খুলিয়া আর এক বৃদ্ধের হাসিমুখ বাহির করণ
বৃদ্ধ। কি হে! এত তর্কাতর্কি
কিসের?
পথিক। আজ্ঞে না, তর্ক নয়।
আমি জল চাইছিলুম, তা উনি সে কথা কানেই নেন না। - কেবলই সাত-পাঁচ গপ্পো করতে
লেগেছেন। তাই বলতে গেলুম তো রেগে-মেগে অস্থির!
বৃদ্ধ। আরে দূর দূর!
তুমিও যেমন! জিজ্ঞেস করবার আর লোক পাও নি? ও হতভাগা জানেই-বা কি, আর বলবেই-বা কি?
ওর যে দাদা আছে, খালিপুর চাকরি করে, সেটা তো একটা আস্ত গাধা। ও মুখ্যুটা কি বললে
তোমায়?
পথিক। কি জানি মশাই- জলের
কথা বলতেই কুয়োর জল, নদীর জল, পুকুরের জল, কলের জল, মামাবাড়ির জল, বলে পাঁচরকম
ফর্দ শুনিয়ে দিলে-
বৃদ্ধ। হুঁ,- ভাবলে খুব
বাহাদুরি করেছি। তোমায় বোকা মতন দেখে খুব চাল চেলে নিয়েছে। ভারি তো ফর্দ করেছেন!
আমি লিখে দিতে পারি, ও যদি পাঁচটা জল বলে থাকে তো এক্ষুণি পঁচিশটা বলে দেবো—
পথিক। আজ্ঞে হ্যাঁ, কিন্তু আমি
বলছিলুম কি একটু খাবার জল—
বৃদ্ধ। কি বলছ, বিশ্বাস হচ্ছে না? আচ্ছা শুনে যাও।
বৃষ্টির জল। ডাবের জল, নাকের জল, চোখের জল, রোদে ঘেমে জ—ল, আহ্লাদে গলে জ—ল, গায়ের
রক্ত জ—ল, বুঝিয়ে দিল যেন জ—ল, কটা হল? গোণো নি বুঝি?
[উৎস: অবাক জলপান // সুকুমার রায়। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
৩.
সরকারী দপ্তর থেকে আজ বেলা সাড়ে দশটায় প্রচারিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে যে, দেশের সমস্ত অঞ্চল থেকে – শহর, শহরতলি ও গ্রামাঞ্চলের আকাশে বিপুল সংখ্যায় পাখিদের জমায়েত হওয়া এবং তার ফলে অবরোধ, ক্ষয়ক্ষতি, এবং ব্যক্তি বিশেষের প্রতি আক্রমণের সংবাদও এসে পৌঁছুচ্ছে। মনে করা হচ্ছে যে বর্তমানে ব্রিটিশ দ্বীপপুঞ্জকে ঘিরে ফেলা মেরু-অঞ্চলীয় বায়ুপ্রবাহের ফলেই পাখিরা এমন বিপুল সংখ্যায় দক্ষিণাঞ্চলে চলে আসছে এবং নিদারুণ ক্ষুধায় জর্জরিত হয়ে তারা হয়তো মানুষকেও আক্রমণ করতে পারে। অতএব গৃহস্থদের সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে তারা যেন বাড়ির জানলা, দরজা ও চিমনির দিকে নজর রাখেন এবং নিজ নিজ শিশুদের খুব সাবধানে রাখেন। এই ব্যাপারে পরবর্তী বিস্তারিত ঘোষণা পরে জানানো হবে।
[উৎস: দ্য বার্ডস // অ্যালফ্রেড হিচকক // অনুবাদ: সুশান্ত কুমার পাল। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি প্রণব পাল লিখলেন
শঙ্খচিল
কষ্টি পাথরে ঘষি মেধাজীবীর ঘিলু আর ঝুরঝুর শব্দে বালুস্কর্যের মরু
ধুধুকার ভূমি। কার সঙ্গে কার হাত বিনিময়। ঘামহারা বালিতে মুখোশ নৃত্য। একটা লম্বা
ইতিহাস ন্যাংটো হেঁটে যাচ্ছে বুকের দিকে। হ্যাংলা জিভের হরহরে লালায় লাট খাচ্ছে
সকালের আলো।আয়নায় কাঁপে আমাদের অদৃশ্য কঙ্কালের প্রেতনাট্য ও মদের নেশাভ্রতা। ঘুমনো
চোখের জোছনায় শ্রীমতী মিছিলের সাথে হেঁটে চলা রাস্তাবতী সুর করে গণতন্ত্র
পড়ছে।লম্বা বেহালার ছড় বাজিয়ে একটা আবহাওয়ার ক্লোনগড়া৷ ভুখার্ত রোদবার।সুদূর
শঙ্খচিল উড়ে যায় নীল সমুদ্দুরের চেতনা ফুঁড়ে হারানো পাখনায়। নতুন উঠোনে পুরনো
সন্ধ্যার হাওয়া। নীলান্ত একলা বসেছে বাউল নিকেতনে।পথ হারানো সেতার লিখছে তার না
বাজার অটোবায়োগ্রাফি ও মলিন ভঙ্গিমা।
ফটিক জল
পুড়তে পুড়তে রোদশ্রী জ্বলে যায়।সোনালি তাপাঙ্কের জুয়েলার্স জুড়ে
কুলুকুলুর স্বপ্নদী।নুন গড়ানো দিন।ফার্নেস জ্বলে গ্রহদের তলপেটে।হাত লুটের মেসিনে
তখন কাটা পড়ছে মানুষ। সাত ঘোড়ার ছোঁয়াচে রোগে ঘুমিয়ে পড়ে শহরের পাখি।সূর্যে
অ্যাক্সিডেন্ট। খাবি খাওয়া আঙুল থেকে চুঁয়ে রস্নার বিমূর্ত রং পোয়াতি মেঘের পেটে।
অনবরত আঙুর টপকানো খুড়োর কলে মেতে ওঠে একটা দেশ। তিন বেলার শুকনো ঠোঁটে চাতক ডেকে
ওঠে। তাসা পার্টির সার্কাসে তাঁবু কাঁপায় ঠাঠা দুপুর বিলাসি রোদ্দুর। কন্ঠনালী
বেয়ে নামে ফটিক জল।
জিন্দাবাদ
আজ ডানায় অবরোধ। হাতের পাতায় লিলিপুট আকাশ লিখছে হল্লাবোল। ট্রাফিক
থমকানো আলোয় নেভা রোদের লাস বিদ্যুতে চমকায়।সময় মেরামত করার টেকনোলজিতে জং ধরা
মরচের পাংচার। নিসর্গের লকআউটে ডানার হুইসেল টাঙাচ্ছে লাল সিগন্যাল। ঘুমানো পায়ের
পাতায় বিদ্যুত হাঁটছ্ রোশনাই দিনের আগাম ডাকতে। মানুষের মাথায় মাথায় চলা
ইলেকট্রনিক সার্কাসে উড়ছে ফাইবার প্লেট। সবুজ ধুঁকছে মাটি বিছানার ধুসর ক্লান্তায়।
শ্রাবন্ত টাঙানো নীলের ছুটিতে প্রতীক্ষা খুলে চলে সম্ভাবনার জট। রিফিল থেকে অনর্গল
রক্তপাতে কাব্যগ্রন্থ উড়ে যায় দূরভিযানে। কারা যেন গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার মানচিত্র
লিখেছিল। আজ ঘরে ঘরে গ্রামীন বার্তায় খালি থালার তেলচিত্র গ্লোবের গায়ে টাঙাচ্ছে
পোস্টার আর কম্পন উঠছে দোতলার ছায়াছবিতে। সাত বেলোর বারান্দায় খসে পড়ে রংতাস। ধুসর
আবিরে শুকনো হোলির রক্ত খেলায় ডেকে যায় চোখ ও আকাশ। আর কোথায় যেন অনর্গল বেড়ে চলে
ডানার জিন্দাবাদ।
No comments:
Post a Comment