আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম
১.
কিসের চিৎকার তবে?
এঞ্জিনিয়ার সাহেব এলেন। কুলিদের নাম-ডাক হলো, দেখা গেল
একজন কুলি অনুপস্থিত। অনুসন্ধানে জানা গেল সে একটু আগে ঘাসের বনের দিকে কী কাজে গিয়েছিল, তাকে ফিরে আসতে কেউ
দেখেনি।
খোঁজাখুঁজি করতে-করতে ঘাসের বনের বাইরে কটা বালির উপরে সিংহের পায়ের দাগ পাওয়া গেল। সাহেব বন্দুক নিয়ে লোকজন
সঙ্গে করে পায়ের দাগ দেখে অনেক দূর গিয়ে একটা বড় পাথরের আড়ালে হতভাগ্য কুলির
রক্তাক্ত দেহ বার করলেন। তাকে তাঁবুতে ধরাধরি করে নিয়ে আসা হল। কিন্তু সিংহের কোনো চিহ্ন মিলল না। লোকজনের চিৎকারে সে শিকার ফেলে পালিয়েচে।
সন্ধ্যার আগেই কুলিটা মারা গেল। তাঁবুর চারপাশের লম্বা ঘাস অনেক দূর পর্যন্ত কেটে সাফ করে
দেওয়া হলো পরদিনই। দিনকতক সিংহের কথা ছাড়া তাঁবুতে আর কোনো গল্পই নেই। তারপর মাসখানেক পরে ঘটনাটা
পুরনো হয়ে গেল, সে কথা সকলের মনে চাপা পড়ে গেল। কাজকর্ম আবার বেশ চলল।
[উৎস: চাঁদের পাহাড় // বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]
২.
নিজের ক্ষমতায় বিশ্বাসটুকু কাল রাতে শিকড় সুদ্ধ নাড়া
খেয়েছে। তাই আক্রোশে বিষিয়ে উঠেছে তার মন, জাতের উপর, সমাজের উপর, দুনিয়ার উপর।
ক্ষমতা থাকলে সে এখনি চুরচুর করে ফেলে দিত এটাকে। রামজী কি জেনেশুনেও লোকের উপর
অবিচার করেন! ছি ছি ! একি ভাবছে সে, সীত্তারাম ! সীত্তারাম ! ... সারারাত একবারও বসেনি সে। রোদ্দুরটাও
আস্তে আস্তে গরম হয়ে উঠছে। পা আর চলতে চায় না। তাৎমাটুলি থেকে অনেক দূরে চলে যেতে
চায় সে, যতদূরে পারে। রোদ্দুরে গা দিয়ে ঘাম ঝরছে। জল তেষ্টাও পেয়েছে। নিজের মনকে
সে বুঝোয় বোধ হয় অনেক দূর চলে এসেছি তাৎমাটুলি থেকে।
দূরে, পাক্কী থেকে ক্রোশখানেক পচ্ছিমে একখান গাঁ দেখা
যাচ্ছে। একসার ডালছাঁটা শিশুগাছ খাড়া দাঁড়িয়ে রয়েছে আকাশ ফুঁড়ে। বর্ষার মত দেখতে
লাগছে। তারই ফাঁক দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা চিলেকোটার দেওয়ালের ছাতলা ধরা সাদা রঙ।
পাকা দালান থাকলেই ইঁদারা থাকবে কাছে। তাই সে ওই বাড়ি লক্ষ্য করে পাক্কী থেকে
নামে; অন্তত খানিকটা জিরিয়েও তো নেওয়া যাবে। ওই বাড়িটা পর্যন্ত যেতে হয়নি। তার
আগেই গাঁয়ে আর একটা কুয়ো দেখে সেখানেই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল।
কুয়োর পাশে একটা কঞির বেড়া। বেড়াটা পলতার লতায় ঢাকা।
পাশের বাড়ির সম্মুখটা ঝকঝকে নিকানো। চালার উপরটা লকলকে লাউঢগায় ঢেকে গিয়েছে। একসার
গাঁদাফুলের গাছ আলো করে রেখেছে উঠোনখানাকে। উঠোনের মধ্যেখানে দোতলার সমান উঁচু
একটা মাচাতে বীজের জন্য রাখা ভুট্টার মালা ঝোলানো। ঢোঁড়াই তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। তার
বুকের ধুকধুকুনিটা ঠেলে, গলা বেয়ে উঠে আসতে চায়। দম বন্ধ হয়ে আসে। ঢোঁক গিলে ঠোঁট
চেপে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়। তার দুঃখ তার নিজের জিনিস, অন্য কারও কাছে
বলবার নয়।
পাশের তামাক-ক্ষেত থেকে একটা ছুঁচলোমুখো লোক এসে
কুয়োতলায় হাতমুখ ধুচ্ছিল। ঢোঁড়াই গিয়ে দাঁড়াল জল খাবার জন্য।
‘ঘর কোথায়?
পুরুব? পাক্কী থেকে কত দূরে? কী জাত?’
‘তন্ত্রিমাছত্রি।’
‘আরে, তাৎমা বল্; তাৎমা বল্।’
[উৎস: ঢোঁড়াই চরিতমানস // সতীনাথ ভাদুড়ী। গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা]
৩.
ত্রীবোলিয়া প্লোচাদে কৃষকদের সংস্কৃতি ভবন। ...তিন
ঘন্টা সেখানে কাটালাম। ফিরে আসার সময় ম্যানেজারকে বললাম, ‘ খুব সুন্দর জায়গা, খুব
ভাল ব্যবস্থা।’...
খুশী হয়ে বললেন তিনি, ‘এক সময় এই বাড়িটা কি কাজে
ব্যবহার হত জানেন?’
‘না, অনুমান করতে পারছি না।’
‘এটা ছিল মস্কোর অন্যতম পতিতালয়। দেখেছেন, ঘরগুলো
কেমনভাবে তৈরী? সব ঘরেই প্রবেশ পথ পৃথক। এই হল তার কারণ।’
‘কিন্তু পতিতারা কোথায় গেলেন? এখন পতিতালয় কোথায়?’
জিজ্ঞাসা করলাম আমি।
তিনি বললেন, ‘এখন কোনো পতিতালয় নেই। পতিতালয় সমূলে
উচ্ছেদ করা হয়েছে। কারণ তার দরকার নেই। আগে যারা পতিতা ছিলেন তারা এখন সবাই কর্মরত
শ্রমিক রমণী। কুড়ি হাজার পতিতার প্রায় পাঁচশো এখন মস্কোতে থাকেন এবং তারা সবাই
শ্রমিক। আপনাদের পুঁজিবাদী দেশের এই অভিশাপকে আমরা সম্পূর্ণ নির্মূল করেছি।
[উৎস: ফার্স্ট টু গো ব্যাক // ইরিনা স্কারিয়াতিনা। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি অনিন্দ্য রায় লিখলেন
১.
বালির ওপর আছে সিংহের পায়ের
ছাপ, আতঙ্ক এবং
কানাঘুষো
এবং ঘাসের বনে টেনে নিয়ে
যাওয়া শিকারের শ্বাস
ফিরিয়ে আনলেও ধরে রাখা যায় না, কারণ সে মানুষ
বালির ওপর থাকে সিংহের পায়ের
ছাপ
কেটে ফেলা হল ঘাস
তাঁবু থেকে অনেকটা দূর অব্দি স্মৃতির লম্বা ঘাস কেটে ফেলা হল
বালির ওপর রইল সিংহের পায়ের
ছাপ
বালি পড়ল
বালি পড়ল
বালি পড়ল
বালি পড়ল
ঢাকা পড়ে গেল সিংহের পায়ের
ছাপ, আতঙ্ক এবং
কানাঘুষো
এবং সিংহ রইল আমাদের দেখার
আড়ালে
এবং সিংহ রইল খাদ্যশৃঙ্খলে
বাঁধা বন্যপ্রাণী হয়ে
২.
কুয়োয় তাকালে দেখা যায় নিজেরই
মুখ
যদি জল থাকে
জল খেতে গেলে নিজেরই কুয়ো
দেখা যায়
যদি মুখ থাকে
যদি প্রতিটি তৃষ্ণার সামনে
একজন দাঁড়িয়ে থাকে
প্রশ্ন করে
সে তাহলে বক
মহাকাব্যে ধর্ম বলা হয়েছে তাকেই
৩.
শ্রম দিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে
পতিতাদের, পড়ে আছে
ঘরগুলি, সব ঘরেই প্রবেশ পথ পৃথক
শ্রম দিয়ে সারিয়ে দেওয়া
হয়েছে পতিতাদের, পড়ে আছে শরীরগুলি, সব শরীরেই প্রবেশ পথ পৃথক
আজ যাঁরা তা দেখতে এসেছেন, যাঁরা তা দেখাতে এসেছেন
প্রত্যেকের ঘর পৃথক, পথ
পৃথক
শরীর পৃথক, অসুখও পৃথক
একটা মাত্র ওষুধ দিয়ে পৃথিবী
সারানোর কথা এখনও বিশ্বাস করে কেউ !
সরাসরি, স্পষ্ট গদ্যাংশকে কবিতায় ধরা, আর কারো সেভাবে চোখে পড়ল না। যদিও অনেক কবিতাই ভালো কিন্তু অনেকক্ষেত্রেই মনে হয়েছে আলাদা কবিতা, গদ্যের সঙ্গে কোনও সম্পর্ক নেই বা সামান্য উল্লেখ করে পৃথক কবিতা। আপনার তিনটি কবিতা শুধু তিনটে গদ্যাংশকে স্পষ্ট ধরেছে, এমনই নয়। গদ্যগুলোকে যেন একটা দিশা দিয়েছে, সম্পূর্ণ করেছে। তারসঙ্গে তিনটি কবিতাতেই রয়েছে নিজস্ব দর্শন।
ReplyDeleteআপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
Delete