দেবাঞ্জন দাস


শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

ঝোপের মধ্যে পাতলা অন্ধকারে চাক চাক কুয়াশা। কথা বললে আমাদের মুখ থেকে কুয়াশা বেরোয়। হঠাৎ মনে হয় পৃথিবী ব সচ্ছিদ্র।
ক্রমশ ধোঁয়ায় আমাদের চোখ লাল হয়ে যেত, আগুনের তাপে শরীর গরম হয়ে উঠত, চেঁচিয়ে গলা ভাঙত। অনেকক্ষন পরে সূর্য যখন উঠে গেছে, রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়েছে, তখন আমাদের মধ্যে কেউ বলত, ‘এত্তিবারে কাউয়ারা নিশ্চয় নেমন্তন্ন পাইয়া গেছে। চল বাড়ি যায়
ততক্ষণে মাদের এজমালি উঠোনে সাদা চাঁদোয়া টাঙানো হয়েছে। মাটি নিকিয়ে সেখানে সারি দিয়ে পিঁড়ি পাতা হয়েছে। পুরো বাড়ির পুরুষেরা এবং শিশুরা একসঙ্গে বসে নবান্ন করবেঘরে ঘরে নতুন সুগন্ধ ধপধপে সাদা চাল শেষরাতে ভিজিয়ে রাখা হয়েছিল, এখন শিল-নোড়ায় বাটা হচ্ছে, এতক্ষন ধরে যে নারকেল কুরিয়ে স্তূপ করা হয়েছিল তাও বাটা হচ্ছে। গতরাত্রেই চাকা চাকা মিছরি ভেজানো হয়েছিল– সেই মিছরির জলে ঐ চাল-বাটা, নারকেল-বাটা, ডাবের জল, গন্ধরাজ লেবুর রস মিশিয়ে কলসিতে কলসিতে স্ত্রীলোকেরা তৈরি করছে নবান্ন।
নবান্নয় বসার আগে চাল কলা পিণ্ডের মতো পাকিয়ে কলা গাছের খোলায় করে আমরা দিয়ে আসতাম বড়পুকুরের ওপাড়ে শ্মশানের কাছে। সেই যে সকালে অত তারস্বরে চেঁচিয়ে নেমন্তন্ন করা হয়েছিল– এসব সেই কাকেদের জন্য। আমরা খানিক দূরে গাছের গুঁড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখতাম, কাকেরা খায় কিনা। কিন্তু আশ্চর্য, একটা কাকেরও দেখা নেই। অপেক্ষা করে করে তখন আমরা আবার মণ্ডপে ফিরে আসতাম। সেখান থেকে লক্ষ রাখতাম। কিন্তু কোথায় কাক ! খানিকক্ষণ পরে অধৈর্য হয়ে আবার গিয়ে দেখি, আরো আশ্চর্য– খোলা সাফ, কারা যেন এসে চেটেপুটে খেয়ে গেছে। কারা খেল? কাক, কুকুর কাউকে আমরা ওদিক পানে যেতে দেখিনি। সে যা হোক, ব্যাপারটা চেপে গিয়ে আমরা নবান্নের চাঁদোয়ার তলায় বড়দের খবর দিতাম, কাকেরা নেমন্তন্ন খেয়ে গেছে।
       তখন একে একে প্রবীণেরা হাতে পাত্র নিয়ে এসে বয়স অনুসারে পরপর বসতেন, যুবকেরা বসত, সব শেষে আমরা, গেলাস বাটি যা পেয়েছি তাই নিয়ে। আমাদের বালকদের দিকের হট্টগোল আস্তে আস্তে মৃদু হতে হতে বুড়োদের দিকে গিয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছে– দীর্ঘ সারির প্রথমে সেখানে বসে আছেন আমার দাদু। ঐখান থেকে পরিবেশন শুরু হবে।
       রাঙাদাদুর ঘর বাদ দিয়ে বাড়ির সব ঘর থেকে বউ-ঝিরা বড় বড় পিতলের কলসি ভরে নবান্ন এনে ইতিমধ্যে একপাশে দাঁড়িয়েছে। প্রথা অনুযায়ী সবচেয়ে বড় বউটি আগে পরিবেশন করবে, তারপরে মেজো, সেজো ইত্যাদি। কর্তারা প্রত্যেকেরটা খেয়ে মনে রাখবেন কারটা কেমন হল। মুখে কোনো রায় না দিলেও যার বানানো নবান্ন তাঁরা আরেকবার চাইবেন, বোঝা যাবে তারটিই এবার সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। সেদিন সেই বউ এর ভারি গর্ব। ছোট ঝগড়াটি হলে কি হবে, প্রতি বছর সেই ফার্স্ট হত।  
 [উৎস: অক্ষয় মালবেরি // মণীন্দ্র গুপ্ত গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা]

২.

শুরা জন্মাবার পর থেকেই আমরা জয়াকে বলতাম- এবার তুমি বেশ বড় হয়েছো, তুমি যে এখন দিদি বড়দের সঙ্গে একটা বেশ উঁচু চেয়ারে ও খাবার টেবিলে বসতো। শুরার সঙ্গে জয়া বেশ মুরব্বীর মত ব্যবহার করত চুষিকাঠিটা ফেলে দিলে তুলে দিত, জেগে গেলে ঘরে কেউ না থাকলে দোলনাটা দুলিয়ে দিত আমিও এখন ওকে আমার অনেক কাজে সাহায্য করতে ডাকি
‘জয়া একটা হাত মোছার রুমাল এনে দাও ত,’ ‘একটা কাপ এনে দাও না’- ‘ও জয়া, আমার ঘর গোছানোয় একটু সাহায্য কর না- বইটা সরিয়ে দাও, চেয়ারটা ঠিকমত রাখ তো...’
বেশ খুসী হয়েই ওসব করত, করা হয়ে গেলে আবার জিজ্ঞেস করত- “আর কিছু করার আছে?”
ওর যখন মোটে তিনবছর বয়স, আর শুরা সবে দুই বছরে পা দিয়েছে তখন এক হাতে শুরার  হাত ধরে আর একহাতে দুধের বোতল নিয়ে ঠাকুরমাকে দেখতে গিয়েছিল
একদিন আমি গরু দোয়াচ্ছিলাম, শুরা কাছেই হামাগুড়ি দিয়ে খেলা করছে আর জয়া এক হাতে কাপ নিয়ে টাটকা দুধ নেবে বলে দাঁড়িয়ে আছে, হঠাৎ গরুর গায়ে মাছি বসতেই লেজটা দুলিয়ে তাড়াতে গিয়ে আমায় গায় লাগিয়ে দিল জয়া তাড়াতাড়ি কাপটা মাটিতে রেখে এক হাতে ধরল গরুর লেজটা, আর এক হাতে একটা ছোট ডাল নিয়ে মাছি তাড়াতে তাড়াতে বলল- “তুমি মাকে মারছ- আর কখনও যেন মেরো না” তারপর আমার দিকে চেয়ে বলল- “আমি তোমাকে সাহায্য করছি
দুজনের মধ্যে কি তফাৎ - জয়া ছোট, আর ছিপছিপে, শুরা হল গোলগাল আর ভারী গড়ন। সারা গ্রামে শুরার সম্বন্ধে আলোচনা হত- আমাদের দিদিমণির ছেলেটি যেমন লম্বা তেমনি চওড়া দাঁড়িয়ে থাকলে যতখানি উঁচু হয় শুয়ে থাকলেও প্রায় ততখানিই।
আর সত্যি বলতে শুরা বেশ ভারী, আঠার মাস বয়সেই ও গায়ের জোরে জয়াকে হারিয়ে দিত, অবশ্য তার জন্য শুরার খবরদারি করা বা দরকারমত তাকে ধমকানোতে জয়া মোটেই পিছপা হত না
জয়া ত প্রথম থেকেই বেশ পরিষ্কার কথা বলত, কিন্তু শুরা তিন বছর বয়স পর্যন্ত “র” বলতে পারত না, জয়া এর জন্যে খুব দুঃখ পেত।
জয়া বলত- “রেন”
শুরা বলত- “লেন”
“ওরকম নয়- বল “রে”
“লে”
“লে’ নয় ‘রে’ কি বোকা ছেলেরে বাবা আবার বল রান্‌”
“লান্‌”
“পরিজ”
“পলিজ”
একবার জয়া ধৈর্য হারিয়ে ভাইয়ের কপালে একটা চড় মেরেছিল কিন্তু চার বছরের মাস্টারমশাইর চাইতে দু’বছরের ছাত্রের জোর অনেক বেশী। সে ধাক্কা দিয়ে জয়াকে ফেলে দিয়ে রেগেমেগে চেঁচিয়ে উঠল- “থামাও বলছি মারামারি

[উৎস: জয়াশুরার কথা // এল কসমোদেমিয়ানস্কায়া // অনুবাদ: শেফালী নন্দী। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]

৩.

রটম্ দু একটা লাফে প্রভার কোলের ওপর উঠে পড়ে। দুই ঊরুর মাঝে কামিজের ভাঁজে একটা সাদা প্রিন্ট ঠোঁট নাড়ে আর বকম বকম শুরু হয়। আমি ধীরে ধীরে উত্তেজিত হতে থাকি। -পুরুষের ভাবখানা এই যে সে-ই সংসারের সৃষ্টিকর্তা, নিয়ামক, প্রতিপালক ও ধ্বংসধ্বনি। এসব সে চাইলো গায়ের জোরে আর গায়ের জোর যে বুদ্ধির পরিবর্ত নয়- এটাই বোঝে না। তেমন একটা ভগবানের নাম করো, একটা দেবদূত, একজন অবতার, একজন ঋষি, একজন গুরু, একজন পুরোহিত, একজন জেনারেল, একজন রাষ্ট্রপতি, একজন শিল্পী, যে পুরুষ নয়। ব্যত্যয় দেখি না। এরা সবাই হয় গায়ের জোরে ক্ষমতায় বসেছে নয়তো পুরুষদের পছন্দ অনুযায়ী হতে পেরেছে। এসব কাজে পুরুষদের যোগ্যতা নিয়ে কোন সন্দেহই রাখতে দেয়নি। যেমন আমার বন্ধু ধরেই নেবে যে তোমাকে যদি সে বিয়ে করে তাহলে ওরই দায়িত্ব হবে উপার্জন করা, বাজার করা, সামাজিক নষ্টামি ও বিপদ থেকে তোমাকে রক্ষা করা, ভবিষ্যতের জন্য সঞ্চয় করা
-এ আর নতুন কি বলছো -এতো হবেই প্রভা বলে -আমাকে সুস্থ জীবন দেওয়া আর রক্ষা করা তো ওরই কাজ হবে
-বলে ফেললে তো? পৃথিবীর কোটি কোটি নারী একথাই বলে তুমিও বলে ফেলো না পুরুষদের খারাপ দিকটা হল যে এই তোমার কথায় সে বিশ্বাস করে কোথায়, ডায়েরী বার করো, লিখে রাখো বন্ধু, এতবার বলেও কোন বদল আমি আনতে পেরেছি বলা যায় না এ ব্যাপারে নাস্তিক আস্তিক সবাই সমান পুরুষ নারীকে তার সম্পত্তি মনে করে রক্ষণাবেক্ষণ করবে একথা মেয়েদেরই শেখানো অথচ আসল ব্যাপার হল নারীই পুরুষকে নিজের সম্পত্তি মনে করে পুরুষকে এমনভাবে বশে রাখে যে সে চাঁদে গিয়েও বলে বউ-এর সাথে কথা বলব এই বশীকরণ সর্বপ্রথম শিখিয়েছিল মাতা এছাড়া হয়তো মেয়েদের টিকে থাকার কোন উপায় ছিল না পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে যে বশীকরণ মন্ত্রটি একই রকম কার্যকর থাকে তার উদ্ভাবক মাতাকে প্রণাম করো প্রভা পৃথিবীর কোন বস্তু, ধর্ম, আবেগ, ঈশ্বর এমনকি চন্দ্র সূর্য্য একই রকম কার্যকর থাকেনি এতদিন
 [উৎস: মাটাম // বারীন ঘোষাল। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]


তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি দেবাঞ্জন দাস লিখলেন


কেন বলবো?

১.
যখন অপার হয়ে ডাকি
ধৈর্য ভাসছিল কলার ডোঙ্গায়
তার চাল-কলা-পিণ্ড
ঠোঁট ছুঁয়ে গ্যালো
কাঁচা দুধ-কাঁঠালি কলায়
ঠোঁট ঈষৎ যেন উল্টালো বিস্বাদে
যেমন মুখাগ্নি ঠোঁট ছুঁয়ে
ছ্যাঁকা দিয়েছিল আমায় 

আমি জলের কাছে বসে
স্মৃতিকে কাক-পক্ষীতে বিলোই
ওদের ডানায় ফেলা আসা লবানের
গন্ধ ওড়ে আকাশে 
আচমন সেরে নির্বিবাদী আমি
জলের মতো স্মৃতিও হাওয়ায় কাঁপে তিরতির...
  

২.
জল-হাওয়ায় গাছ বাড়ে
স্মৃতি আমাকে বড় করে
মেঘ ডাকলে ঠাকুমা বলত
             চিড়িক ঝনঝনি
আমার ভয় শূন্য ঘরে
আজও ঝনঝন করে
নীচের গুল্মকে মনে রেখে
বৃক্ষ তার পাতা সরিয়ে সূর্যকে ডেকেছিলো

আমার মেয়েকে
কবিতা শেখায় ওর পাঁচ বছরের দাদা
বোনের ভুলে তার হাসি
আজও সূর্যমুখী ফোটায়

যে ভার প্রকৃতি থেকে আসে
তাকে জলদান কর
মানুষের পৃথিবীতে ফুল ফুটবে নির্ভার...



৩. 
নিজেকে আমি বলে
ভুল করতে করতে মানুষ বড় হয়
ছড়িয়ে যাওয়া সর্ষের গুন জেনে
আমাদের কী লাভ বল...
আমরা গণেশ মার্কা তেল খুঁজি কেবল

আয়না থেকে দূরে রাখা শিশু
সাজপোশাকে আয়না পায়
তার মুকুর পা রাখে সংসারের পুকুর ধাপে

গাছের মতো এক পায়ে
ঠায় দাঁড়াতে পারলে
সে দেখত
ময়ূরের তীক্ষ্ণ ডাকে চরাচর ছিঁড়ে যাচ্ছে
আসব আসব করেও
জ্যোৎস্না আসে না রোজ
তবু সন্ধ্যা হলে
আমরা গান গাই
সুগন্ধ ছড়াই

মিথ্যেগুলোর যত্ন নেই ভালোবেসে 

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

4 comments:

  1. খুব ভালো লেখা।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

      Delete
  2. প্রথম দু'টি ভাল। শেষটিতে একটু তাল কাটল।

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।

      Delete