তপেশ দাশগুপ্ত


শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

নিকি ঘুমিয়ে যাবার পর ক্রিনিটি তার শরীরটি একটি পাতলা চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়। তারপর তার গলার মাদুলিটি খুলে নিয়ে সে ক্রিস্টাল রিডারের সামনে বসে। মাইক্রোফোনটি টেনে নীচু গলায় দিনলিপিটি রেকর্ড করতে শুরু করে :

পৃথিবী থেকে সব মানুষের মৃত্যু হবার পর মূল তথ্য কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে গেছে, এই এলাকার যোগাযোগটিও বিচ্ছিন্ন। আমি তাই কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারছি না। আমি বিচ্ছিন্ন ভাবে স্মরণ করতে পারি, কোনো একটি মানব শিশু যদি কোনো পশুপাখি দ্বারা লালিত পালিত হয়। তাহলে সে সেই পশুপাখির কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারে। নেকড়ে বাঘ দিয়ে লালিত কিছু শিশু নেকড়ে বাঘের মতো চার পায়ে ছুটতে পারত, বুনো কুকুর দ্বারা লালিত শিশু কুকুরের কিছু বৈশিষ্ট্য অর্জন করেছিল। ওরাংওটাং দিয়ে পালিত শিশু গাছে ওরাংওটাং-এর মতো ছুটে বেড়াতে পারত।

নিকি খুব শৈশব থেকে এই বনের কিছু পশুপাখির সাথে বড় হয়েছে। আমি সতর্ক দৃষ্টি রেখেছি বলে পশু পাখির প্রবৃত্তি তার মাঝে গড়ে ওঠে নি, কিন্তু আমার বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে যে নিকি পশুপাখির সাথে কোনো একটি উপায়ে তথ্য বিনিময় করতে পারে।

আমি আজকে নিকিকে বলেছি কিকি কাক জাতীয় প্রাণী এবং কাক জাতীয় প্রাণীরা দল বেঁধে থাকে। নিকি বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে কিকিকে তার প্রমাণ দেখাতে বলেছে। কিকি তার প্রমাণ হিসেবে বনভূমির সকল পাখিকে তার সামনে হাজির করেছে। আমি দেখেছি হাজার হাজার পাখি নিকিকে ঘিরে ঘুরছে। নিকি পাখি বা অন্যান্য প্রাণীর সাথে কিভাবে তথ্য বিনিময় করে সেটি আমি এখনো পুরোপুরি বুঝে উঠতে পারি নি। তৃতীয় মাত্রার রোবট হিসেবে আমার কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, আমি হয়তো কখনোই বিষয়টি বুঝতে পারব না।

আমি বাইভার্বালটি প্রস্তুত করেছি। খুব দ্রুত আমি নিকিকে নিয়ে বের হব। মানুষ যখন বেঁচেছিল আমি তখন তাদের মুখে এই বনভূমিটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রশংসা শুনেছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা যোগাযোগের নেটওয়ার্কের বাইরে। পৃথিবীতে কোনো মানুষ জীবিত আছে কিনা সেটি বের করতে হলে আমাকে সভ্যতার আরো কেন্দ্রবিন্দুতে উপস্থিত হতে হবে।
[উৎস: রবো নিশি // মুহম্মদ জাফর ইকবাল। গদ্য নির্বাচনে: অমিতাভ প্রহরাজ]

২.

জীবনের পথে ঘুরতে ঘুরতে,- সংসারের অতিথশালা থেকে যখন বিদায় নেবার সময় এসেছে, মরণের সিন্ধুকূল থেকে আমার জীর্ণশীর্ণ দেহখানিকে টেনে এনে, আমার সেই কত দিনের পুরাণ স্মৃতি কে ঘ’সে মেজে জাগিয়ে তোলার আবার চেষ্টা করছি কেন?  এ কেন’র উত্তর নেইউত্তর খুঁজে পাই না তবে একটা কথা আমার মনে হয় মনে হয়, বালিকা ও কৈশোরে আমার শাদা মনের উপর প্রথমে লাল রঙের ছোপ পড়ে, বহু বর্ষের বহু-বর্ণ-বিপর্য্যয়েও সে আদিম লালের আভা আজও আমার কুয়াসাচ্ছন্ন মন থেকে একেবারে মিলিয়ে যায় নি কালের যবনিকা ভেদ ক’রে এখনও সে রঙ্ মনের মাঝে উঁকিঝুঁকি মারে কোন কিছু বলতে গেলে তাই আগে মনে পড়ে সেই কথা, যা আমার কাছে এখনো সুখ-স্বপ্নের মতো মধুর, যার মাদকতার আবেশ ও আবেগ এখনও আমি ভুলতে পারি নি- আর যা বোধহয় আমার জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত সঙ্গের সাথী হয়েই থাকবে তাই বোধহয় আমার এই অভিনেত্রী জীবনের কথা বলবার সাধ
সাধ তো! কিন্তু ক্ষমতা আমার কতটুকু? আর বলবোই বা কি? কোন্ কথা রেখেই বা কোন্ কথা বলি? জানি না তো কিছুই আজ-কালকার থিয়েটার মাঝে মাঝে দেখি; কেমন নেশা! সব কাজের মধ্যেও থিয়েটার যেন টানে। দেখি, আজ-কালকার সব নতুন নতুন অভিনেতা অভিনেত্রী, সু-শিক্ষিত সুমার্জ্জিত, কত নতুন নাটক, কত দর্শক, কত হাততালি, সোরগোল, হৈ-হৈ সেই ফুটলাইট- সেই দৃশ্যের পর দৃশ্য- সেই যবনিকা পড়ার সময় ঘন্টার ঢং ঢং শব্দ,- আর কত কথাই না মনে পড়ে! আমরাও তো একদিন এমনি করে সাজতেম, সেই সেকালের মত দর্শক, সেই সেকালের মত রঙ্গসাথী, সেকালের সাজপোষাক, সেকালের নাটক, সেকালের গ্যাসের ফুটলাইট, সেকালের আবহাওয়া
[উৎস: আমার কথা ও অনান্য রচনা // বিনোদিনী দাসী। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]

৩.


নব্বই বছর আগে জনৈক যজ্ঞনাথ কুন্ডু বহুজনহিতায় এই ঘাট বাঁধিয়ে দিয়েছিল হয়ত পুণ্যলাভের কারণে, কিংবা নিজের নাম অক্ষয় করে রাখার তাড়নায়। চাতাল এর মাঝখানে গাঁথা শ্বেতপাথরের ফলকে তার নাম এবং ঘাট প্রতিষ্ঠার সন তারিখ অস্পষ্ট হয়ে এলেও একটু আধটু পড়া যায় তবে আর কিছুদিন বাদে লোকজনের পায়ের ঘষায় যজ্ঞনাথ পৃথিবী থেকে সম্পূর্ণ মুছে যাবে তার অমরত্বের আয়ু বড়জোর একানব্বই বা বিরানব্বই বছর
[উৎস: জন্মদাতা // প্রফুল্ল রায়। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]


তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি তপেশ দাশগুপ্ত লিখলেন

১.
আমি তো আছি
তুমি আমায় কোথায় দেখবে গো
প্রেমে দেখো
সান বাঁধানো সিঁড়িতে ম্লান
অপসৃয়মান চাঁদের দিকে শেষ রাতে
মাইটোকন্ড্রিয়া পেটের থেকে জঙ্ঘা জুরে
বেয়ে বেয়ে উঠে আসছি
রোবট হওয়ার আগে
প্রেমের প্রথম মাসের পাঠ বাকি ছিল
ধরতাই খু্ঁজতে গিয়ে
পুরাতনে
পুরাতনি তে দেখেছ যা কিছু
ততটুকুই চিপস্
ততটুকুই লাবডুব
 Love
 অম্বালিকা অব্দি
গতকাল মৃত
ছিলে দুহিতা ছাড়িয়ে
আজকে আবার এসেছ আর বাসের চাকা
গাইছে ফিরে আসা
ঝাপুস ঝুপুস
রোবটের থিম সঙ বড়জোর
পর্দা উঠছে
আর ব্ল্যাক স্ক্রীণ মাইল ফলকে
রাধা গাইছে
অন্তরাল ফুটে উঠছে অতীত জুরে
নিষিদ্ধ করেছি বাইরেদের হতে
তার পিছে অনন্ত
ছায়া ছায়া   রহস্য   লোক নেই
হাতে চিপস্ নিয়ে
কুল পাচ্ছ না
মিসিং ডাটা জায়মান প্রেমের প্রথম মাস
তার কোনো অতীত নেই
বর্ত্তমান ফাঁকা
ভবীষ্যৎ হীন
এই দুর্দ্দান্ত চাকা ঘোরাচ্ছে
শ্যামলী ছিল না শ্যামলী নেই থাকবে না

২.
মুঠ বন্ধ করে বসে আছি
তুমি মুঠ খুলবে এসে
হাড়গোড় খুলবে এসে


৩.
ইন্দ্রের কবিতা দেখে
আমার কবিতা লিখতে ইচ্ছে হয়েছে কত
এরকম কত আছে
তাদের কবিতাগুলি বয়ে নিয়ে যায়
হৃদয়ে হৃদয়ে
কবিতা লেখা হয়
ফুল ফোটে
আমরা বছরের পর বছর দেখি

ফুল ফুটে আছে  

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

No comments:

Post a Comment