আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম
১.
অমাবস্যার সংশয়পূর্ণ দিবস ধীরে ধীরে ক্ষয় হইয়া আসিল।
অপ্রত্যাশিত কিছু ঘটিল না। কেবল দ্বিপ্রহরে মাধব চুয়ার গৃহে আসিয়া তদারক করিয়া গেল
ও জানাইয়া গেল যে, আহার
প্রদত্ত শাস্ত্রীয় -বিধান যেন যথাযথ পালিত হয়।
এখানে চাঁপার কাজ শেষ হইয়াছিল; মাধবের অনুমতি পাইয়া সে প্রমোদ-উদ্যানে পূজার আয়োজন করিতে গেল।
সায়াহ্নে নবদ্বীপের ঘাটে স্নানার্থীর বিশেষ ভিড় ছিল না। দুই-চারি জন নারী গা ধুইয়া যাইতেছিল, কেহ কেহ কলসে ভরিয়া গঙ্গাজল লইয়া যাইতেছিল। পুরুষের সংখ্যা অল্প। কেবল একজন পুরুষ অধীরভাবে সোপানের উপর পদচারণ করিতেছিল ও মাঝে মাঝে স্থির হইয়া উৎকর্ণভাবে কি শুনিতেছিল। তাহার গলায় মুক্তাহার বিলম্বিত—অন্যথা সাধারণ বাঙালীর বেশ। বলা বাহুল্য, সে চন্দনদাস।
এখানে চাঁপার কাজ শেষ হইয়াছিল; মাধবের অনুমতি পাইয়া সে প্রমোদ-উদ্যানে পূজার আয়োজন করিতে গেল।
সায়াহ্নে নবদ্বীপের ঘাটে স্নানার্থীর বিশেষ ভিড় ছিল না। দুই-চারি জন নারী গা ধুইয়া যাইতেছিল, কেহ কেহ কলসে ভরিয়া গঙ্গাজল লইয়া যাইতেছিল। পুরুষের সংখ্যা অল্প। কেবল একজন পুরুষ অধীরভাবে সোপানের উপর পদচারণ করিতেছিল ও মাঝে মাঝে স্থির হইয়া উৎকর্ণভাবে কি শুনিতেছিল। তাহার গলায় মুক্তাহার বিলম্বিত—অন্যথা সাধারণ বাঙালীর বেশ। বলা বাহুল্য, সে চন্দনদাস।
ক্রমে সূর্য নদীর পরপারে অস্তমিত হইল। নিদাঘকালের দ্রুত
সন্ধ্যা যেন পক্ষ বিস্তার করিয়া আসিয়া ভাগীরথীর জলে ধূসর ছায়া বিছাইয়া দিল। পাশে
নৌকাঘাট নির্জন ও নিস্তব্ধ। জেলে-ডিঙ্গি একটিও নাই। দুই-একখানি
স্থূলকলেরব মহাজনী কিস্তি নিঃসঙ্গ অসহায়ভাবে বিস্তীর্ণ ঘাটে লাগিয়া আছে।
গঙ্গাবক্ষেও নৌকা নাই। কেবল দূরে উত্তরে একটি ক্ষুদ্র ডিঙ্গি স্রোতের মুখে ভাসিয়া আসিতেছে। অস্পষ্ট আলোকে মনে হয়, একটি লোক দাঁড় ধরিয়া তাহাতে বসিয়া আছে।
ক্রমে ডিঙ্গি মাঝগঙ্গা দিয়া ঘাটের সম্মুখীন হইল; কিন্তু ঘাটের নিকটে আসিল না, গঙ্গাবক্ষে স্থির হইয়া রহিল। নৌকারূঢ় ব্যক্তি মাঝে মাঝে দাঁড় টানিয়া নৌকা ভাসিয়া যাইতে দিল না।
চন্দনদাস চিন্তিতমুখে অধীরপদে ঘুরিতে ঘুরিতে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল—ঐ আসিতেছে। পথে দূরাগত বাদ্যোদ্যম শুনা গেল। চন্দনদাস একবার গঙ্গাবক্ষস্থ ডিঙ্গির দিকে তাকাইল, তারপর স্পন্দিতবক্ষে একটি গোলাকার বুরুজের উপর গিয়া বসিল। বাদ্যধ্বনি ক্রমশ কাছে আসিতে লাগিল। মহারোলে কাঁসর-ঘণ্টা শিঙা-ঢোল বাজিতেছে। তামাসা দেখিবার জন্য বহু স্ত্রী-পুরুষ-বালক জুটিয়াছিল, তাহাদের কলরব সেই সঙ্গে মিশিয়া কোলাহল তুমুল হইয়া উঠিয়াছে।
ঘাটের শীর্ষে আসিয়া কোলাহল থামিল; বাজনা বন্ধ হইল। চন্দনদাস দেখিল, কৌতূহলী জনতাকে দ্বিধাবিভক্ত করিয়া দুই সারি ঢাল-সড়কিধারী পাইক নামিয়া আসিতেছে। তাহাদের দুই সারির মধ্যস্থলে মুক্তকেশী জবামাল্য-পরিহিতা চুয়া। চন্দনদাসও কৌতূহলী দর্শকের মতো দাঁড়াইয়া এই বিচিত্র শোভাযাত্রা দেখিতে লাগিল।
পাইকগণ সদম্ভে অস্ত্র আস্ফালন করিয়া দর্শকদের ঠেলিয়া সরাইয়া দিয়া ঘাটের দিকে নামিতে আরম্ভ করিল। তাহাদের মধ্যবর্তিনী চুয়া মন্থরপদে এদিক-ওদিক চাহিতে চাহিতে সোপান অবরোহণ করিতে লাগিল।
[উৎস: চুয়াচন্দন // শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। গদ্য নির্বাচনে: অমিতাভ প্রহরাজ]
২.
মুসলমান ধর্ম্মশাস্ত্রানুমোদিত পর্দা রক্ষা করিয়া দেশ বিদেশ ভ্রমন করা যায়, এ কথা অনেকেই বুঝে
না। তাই তাহারা বাড়ী
ছাড়িয়া কোথাও যাইতে হইলে মহা বিপদ্ ভাবে। শাস্ত্রে পর্দা সম্বন্ধে যতটুকু কঠোর ব্যবস্থা আছে, প্রচলিত
পর্দা প্রথা তদপেক্ষাও কঠোর! যাহা হউক কেবল শাস্ত্র মানিয়া চলিলে অধিক অসুবিধা ভোগ
করিতে হয় না। আমার বিবেচনায় প্রকৃত পর্দা সেই রক্ষা করে, যে সমস্ত মানবজাতিকে সহোদর ও সহোদরার ন্যায় জ্ঞান করে।
আমাদের বাসা হইতে প্রায় এক মাইল দূরে বড় একটি ঝরণা বহিতেছে; এখান হইতে ওই
দুগ্ধফেননিভ জলের স্রোত দেখা যায়। দিবানিশি তাহার কল্লোল গীতি শুনিয়া ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির উচ্ছ্বাস দ্বিগুন ত্রিগুন বেগে প্রবাহিত হয়। বলি, প্রাণটাও কেন ঐ নির্ঝরের ন্যায় বহিয়া গিয়া পরমেশ্বরের চরণ প্রান্তে লুটাইয়া
পড়ে না?
অধিক কি বলিব, আমি পাহাড়ে আসিয়া অত্যন্ত সুখী এবং ঈশ্বরের নিকট কৃতজ্ঞ হইয়াছি। সমুদ্রের সামান্য নমুনা, অর্থাৎ বঙ্গোপসাগর
দেখিয়াছি; বাকী ছিল
পর্ব্বতের একটু নমুনা দেখা। এখন সে সাধও
পূর্ণ হইল।
না, সাধ ত মিটে নাই! যত দেখি, ততই দর্শন-পিপাসা শতগুণ বাড়ে! বিভু কেবল দুইটি চক্ষু দিয়াছেন, তাহা দ্বারা কত দেখিব? প্রভু অনেকগুলি চক্ষু দেন নাই কেন? যত দেখি, যত ভাবি, তাহা ভাষায়
ব্যক্ত করিবার ক্ষমতা নাই।
প্রত্যেকটি উচ্চ শৃঙ্গ, প্রত্যেকটি ঝরণা প্রথমে যেন বলে, “আমায় দেখ! আমায় দেখ!”
যখন তাহাকে বিস্ময়-বিস্ফারিত নয়নে দেখি, তখন যেন তাহারা ঈষৎ হাস্যে ভ্রুকুটি করিয়া বলে,
“আমাকে কি দেখ? আমার স্রষ্টাকে স্মরণ কর!”
ঠিক কথা। চিত্র দেখিয়া চিত্রকরের নৈপুণ্য বুঝা যায়। নতুবা কেবল নাম শুনিয়া কে
কাহাকে চিনে? আমাদের জন্য হিমালয়ের এই পাদদেশটুকু কত বৃহৎ, কত বিস্তৃত- কি মহান্ ! আর সেই মহাশিল্পীর সৃষ্ট জগতে হিমালয় কত ক্ষুদ্র!
-বালুকাকণা বলিলেও বড় বলা হয়!
[উৎস: কূপমণ্ডূকের হিমালয় দর্শন // বেগম রোকেয়া। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]
৩.
একবার তলস্তয় আমার সামনে চেখভের
একটা গল্পের- খুব সম্ভব ‘প্রিয়তমা’ গল্পটির
প্রশংসা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেনঃ ‘এ যেনো কোন এক
শুদ্ধচিত্ত কুমারীর হাতে বোনা লেস। সেকালে ক্রুশ কাঁটার কাজে দক্ষ এমন মেয়ে ছিল
যারা তাদের সারা জীবন ধরে তাদের সমস্ত সুখস্বপ্নের রূপ দিত কোন একটা নক্শার
মধ্যে। তারা তাদের সবচেয়ে মিষ্টি স্বপ্ন দিয়ে নক্শা বুনতো,
নিজেদের সমস্ত আবছা ও বিশুদ্ধ স্বপ্নকে বুনে বানাত একটা লেসের কাজ।’ অত্যন্ত আবেগভরে কথাগুলি বলতে বলতে তলস্তয়ের চোখ জলে ভরে
আসছিল।
কিন্তু সেদিন চেখভের জ্বরের
তাপমাত্রা বেশি ছিল। তিনি বসে ছিলেন। তার গালে ফুটে উঠেছিল লাল আভা। তিনি মাথা
নীচু করে সযতনে পিঁশনে চশমার কাচ ঘষছিলেন। অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর শেষকালে
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সলজ্জভাবে মৃদুস্বরে বললেনঃ ‘গল্পটার মধ্যে ছাপার কিছু ভুল আছে...’
[উৎস: আন্তন চেখভ // ম্যাক্সিম গোর্কি। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি মণিদীপা সেন লিখলেন
১.
যতটুকু ব্যাথা তুমি বুকপকেটে রাখছ আজকাল, ততটাই আমার বিভাজিকায় তোড়া তোড়া জুঁই। মোড় পেরিয়ে ডানদিক বরাবর- চওড়া বিটুমিন সাঁতলে চলে পরিবহনের ঢেউ অসংযমী টোটোবাতাস ছাপিয়ে পরিশ্রুত গন্ধ,
উঠে আসে সূর্য না পৌঁছানো হাজার বছরের বনেদী অন্ধকার, ঐতিহ্যে ডুবিয়ে নেয় ; তার স্যাঁতস্যাঁতে থেকে দেখা যায় একটা কোমর দুটো হাত। হাতের আঙুল সেই আঁধারে আঁকে আলোজানলা
সিল্যুয়েট; আস্তিনে শঙ্খলাগা সাপ। সাপের
মুখে পাতা কবজির নীল। প্রতি ছোবলে চোখ বুজে আসে। হাসি। কৌটোহাতে আড়াল দিই বুক,
তুখোড় জুঁইসুবাস।
২.
এক তথাগত-মনখারাপদিন। সবত্র অনীহা বা ঔদাস্য।
গতকাল সারারাত বৃষ্টি ; ষোলোর রাতেও বৃষ্টি ছিল, তোমার বুক ছুঁয়ে পাথরের বিছানায় জমতে জমতে
অনিবার্য আর্টিজীয় স্ফূরণ।
সকাল থেকে অভুক্ত। মুখের ভেতর জিভ সরেস থাকলেও দাঁতেরা যেন দাঁত মাজেনি। পাতার জরায়ুমুখে বেড়ে চলেছে সময়, বাদামী হয়ে যাচ্ছে তরুণ ক্লোরোফিল।
কতকটা অসমান আপোষ এখন... কোনো কোনো শহরে আকাশের রঙ হয়না। প্রকৃতি হয়। বিবর্ণ। ঘোলা। কি যেন এক কৃতার্থ হওয়ার পিপাসা কাজ করছে সারাদিন; মনে পড়ছে, ভালুক সেজে মৌমাছির ঘর ভাঙছ তুমি।
৩.
চোখের নিচ এক কড় বসে যাচ্ছে। সেখানেই জমা অদ্ভুত জল। অর্ধনির্মিত
শহর থেকে ভেঙে আনা একটা একটা খোয়া জলাশয়ে সাজিয়ে দিচ্ছি।
খোয়া, 'ব' এর
আকারে।
তারপর।
তুমি কি স্বপ্ন দেখলে? শেষ কি স্বপ্ন দেখলে? তুমি কি শেষ স্বপ্ন
দেখলে?
শেষ ঘুম সত্যি হলেও স্বপ্নের শেষ!
যা তুমি মৃত্যু বলে ভেবেছ, তা নিশ্চিত স্বপ্নের জাইগোট।
৪.
সামনে একটা হলুদ দেওয়াল। সারাদিন চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকি। মাঝেমাঝে
ওপর দিকের একটা ইঁট খুলে, কেউ কথা বলে। তার
মুখ দেখতে পাইনা। দেখিনি কোনোদিন। একদিন একটা দড়ি নেমে আসে। ইঁটখোলামুখ পর্যন্ত
পৌঁছে দেখি, চকচক করছে একটা আয়না! আস্তে আস্তে ঢুকে পড়ি আয়নায়। দড়ি তুলে নিই। ইঁটের ফোকর বুজিয়ে দিতে
গিয়ে দেখি হুবহু আর একটা আমি এসে দাঁড়িয়েছে হলুদ দেওয়ালের সামনে।
আমি কথা বলে উঠি!
'এবং চিলেকোঠা'র লেখাগুলির সুবাস পেলাম। সব ক'টি লেখা ভালো লেগেছে । তারইমধ্যে চার নংটা সবার ওপরে।
ReplyDeleteআপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
Delete