অনির্বাণ বটব্যাল


শিল্পে কবিতা সুকুমার, এই ভাবনাটি প্রচল। গদ্যের অনুষঙ্গে কবিতাকে দেখেছি বারবার। তাই একটু উলটে, পালটে দিল রেহেল। কবিকে দেওয়া হল তিনটি গদ্যের অংশ। বলা হল এই তিনটি গদ্যাংশ কে নিজের মতো গ্রহণ করে লিখতে হবে অন্তত তিনটি কবিতা। নির্বাচিত কবিরা বাউন্সার শুধু সামলালেনই না সপাটে মাঠের বাইরে ফেললেন কেউ কেউ। 

আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম

১.

গুন্টার গ্রাসকে আমরা আশ্বাস দিতে পারি, যে-পরাশক্তির প্রভুত্ব নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে ওয়েস্টমিনস্টার-মার্কা গণতন্ত্রের ভেলকি দেখিয়ে কিংবা তোপের মুখে তাদের এদেশী দালালরা শান্তিপূর্ণ অবস্থার মায়াসৃষ্টির যত আয়োজনই করুক না, ওরকম শান্তি আমাদের দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে না পেটে যাদের খাবার নেই, আর কিছু না-হোক পেটটা তাদের জ্বলবেই আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসারের উৎস আমাদের দমবন্ধ-করা-শান্তি নয় - দীর্ঘদিনের অনাহার অর্ধাহারহ্যাঁ, অনাহার ও অর্ধাহারই হল আমাদের আলসার এর প্রধান কারণ বহুকাল থেকে আমরা ঠিকমতো খেতে পাই না এক হাজার বছর আগে লেখা সবচেয়ে পুরনো বাংলা কবিতা শুরু হয়েছে অন্নহীন হাঁড়ির খবর দিয়ে অনাহারে অর্ধাহারে পেটের অসুখের ঐতিহ্যও আমাদের বহুকালের শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আমাদের বহু লোকালয়, বহু জনপদ উজাড় হয়ে গেছে কলেরায় কাল মার্কস, এমনকী, ১৮১৭ সালের একটি মহামারীর কথা উল্লেখ করেছেন এই কলেরা প্রথম দেখা দেয় আমাদের যশোরে, সেখান থেকে এশিয়া হয়ে তা চলে যায় ইউরোপে, সেখানে প্রচণ্ড লোকক্ষয় করে যায় ইংল্যান্ডে এবং সেখান থেকে আমেরিকায় আজ আণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য পরাশক্তিগুলো কোটি কোটি টাকা খরচ করে, আর আমাদের দেশের মানুষের অনাহারজনিত পেটের রোগ উপশমের কোনো লক্ষণই চোখে পড়ে না
আমাদের আলসারের ব্যথা দিনদিন অসহ্য হয়ে উঠছে স্ফীতোদর সর্বগ্রাসী পুঁজিবাদকে শ্লেষ আর বিদ্রুপে বিদ্ধ করে এই ব্যথাকে চিরে চিরে দেখার মতো সময় শেষ হয়ে এসেছে, সেই বিলাসিতা আমাদের পোষায় না। পুঁজিবাদের গতর রোজই একটু একটু করে মোটা হচ্ছে, উপমহাদেশের বিভিন্ন পয়েন্টে মোতায়েন তাদের নপুংসক ও পঙ্গু কুকুরগুলোর দাঁতের ধারও বাড়ছে অবস্থা এমন যে এদের কামড়ে আলসার-ভোগা মানুষের জলাতঙ্ক হবার সম্ভাবনা দেখা গেছে তাদের হাত থেকে অস্ত্র নিয়ে তাদের দিকে তাক করতে না-পারলে আমাদের আলসার ও সম্ভাব্য জলাতঙ্ক থেকে রেহাই পাওয়ার কোনো উপায় নেই
গুন্টার গ্রাস আমাদের এইসব রোগের কারণ নিশ্চয়ই শনাক্ত করতে পারেন অসকারের বয়স এখন ৬০ বছর তবু আমাদের কাছে সে চিরকালের তরুণ পঙ্গু ও নপুংসক সাবালকদের লিস্টে সে নাম লেখায়নি তার হাতে এবার আরো শক্ত, আরো কর্কশ একটি ড্রাম তুলে দেওয়ার কথা গুন্টার গ্রাস কি বিবেচনা করে দেখবেন?
[উৎস: গুন্টার গ্রাস ও আমাদের গ্যাস্ট্রিক আলসার // আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। গদ্য নির্বাচনে: উমাপদ কর]

২.

তোমার কি লোকাতীত মহিমা! তুমি বিধবাকে সধবা কর, বিদেশীকে দেশে আন, তোমার স্পর্শে কারাবাসীদের শৃঙ্খল ছেদ হয়, তুমি রোগীর ধন্বন্তরি, তোমার রাজ্যে বর্ণভেদে ভিন্নতা নাই, তোমার রাজনিয়ম জাতিভেদে ভিন্ন হয় না; তুমি আমার প্রাণকান্তকে তোমার নিরপেক্ষ রাজ্যের প্রজা করিয়াছ নচেৎ তাঁহার নিকট হইতে পাগলিনী জননী মৃত পুত্রকে কিরূপে আনিলেন। জীবিতনাথ পিতা ভ্রাতা বিরহে নিতান্ত অধীর হইয়াছেন। পূর্ণিমার শশধর যেমন কৃষ্ণপক্ষে ক্রমে২ হ্রাসপ্রাপ্ত হয়, জীবিতনাথের মুখলাবণ্য সেইরূপ দিন দিন মলিন হইয়া একেবারে দূর হইয়াছে।  মা গো, তুমি কখন্ উঠিয়া আসিয়াছ? আমি আহার নিদ্রা পরিত্যাগ করিয়া সতত তোমার সেবায় রত আছি, আমি কি এত অচৈতন্য হয়্যে পড়েছিলাম? তোমাকে সুস্থ করিবার জন্যে আমি তোমার পতিকে যমরাজার বাড়ী হইতে আনিয়া দিব স্বীকার করিয়াছি, তুমি কিঞ্চিৎ স্থির রহিয়াছিলে এই ঘোর রজনী, সৃষ্টিসংহারে প্রবৃত্ত প্রলয়কালের ভীষণ অন্ধতামসে অবনী আবৃত; আকাশমন্ডল ঘনতর-ঘনঘটায় আচ্ছন্ন; বহ্নিবাণের ন্যায় ক্ষণে২ ক্ষণপ্রভা প্রকাশিত; প্রাণিমাত্রেই কালনিদ্রানুরূপ নিদ্রায় অভিভূত; সকলই নীরব; শব্দের মধ্যে অরণ্যাভ্যন্তরে অন্ধকারাকুল শৃগালকুলের কোলাহল এবং তস্করনিকরের অমঙ্গলকর কুক্কুরগণের ভীষন শব্দ; এমত ভয়াবহ নিশীথ সময়ে জননী, তুমি কিরূপে একাকিনী বহির্দ্বারে গমন করিয়া মৃত পুত্রকে আনয়ন করিলে?
[উৎস: নীল দর্পণ // দীনবন্ধু মিত্র। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]

৩.

আমার ভাবতে ভালো লাগলো বুড়োটা ক্ষেতে দাঁড়িয়ে একা-একা মাটি কোপাচ্ছে
আমাদের দিন, কুক ভগোতীলালকে নিয়ে আমাদের পাঁচজনের দিন আন্ডা হল্টের তাঁবুর মধ্যে কোনোরকমে কেটে যাচ্ছিলো মাঝে মাঝে এক-একদিন সৈনিক-বোঝায় ট্রেন আসছিলো, থামছিলো, চলে যাচ্ছিলো। মাহাতো-গাঁয়ের লোক ভিড় করে এসে কাঁটাতারের ধারে সারি দিয়ে দাঁড়াতো, হাত বাড়িয়ে সবাই ‘সাব বখশিশ সাব বখশিশ’ চেঁচাতো।
হঠাৎ এক-একদিন মাহাতো বুড়োকে দেখতে পেতাম কোনো দিন ক্ষেতের কাজ ফেলে দু হাতের ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে হনহন করে এগিয়ে আসতো, রেগে গিয়ে ধমক দিতো সকলকে ওর কথা শুনছে না বলে কখনো বা অসহায় প্রতিবাদের চোখে গাঁয়ের লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতো
কিন্তু ওর দিকে কেউ ফিরেও তাকাত না সৈনিকরা হিপ পকেটে হাত দিয়ে হা-হা করে হাসতে হাসতে মুঠো-ভরতি পয়সা ছুঁড়ে দিতো। মাহাতো-গাঁয়ের লোক হুমড়ি খেয়ে পড়তো সেই পয়সাগুলোর ওপর, নিজেদের মধ্যে কাড়াকাড়ি করতে গিয়ে ঝগড়া বাধাতো তা দেখে সৈনিকরা হা-হা করে হাসতো
শেষে পর পর কয়েক দিনই লক্ষ করলাম টাঙি-জুতো পরা মাহাতো বুড়ো আর আসে না মাহাতো বুড়ো ওদের দেখে রেগে যেতো বলে, মাহাতো বুড়ো আর আসতো না বলে আমার এক ধরনের গর্ব হতো কারণ, এক-এক সময় ঐ লোকগুলোর ব্যবহারে আমরা - আমি আর ভগোতীলাল খুব বিরক্তি বোধ করতাম ভিতরে ভিতরে লজ্জা পেতাম ওদের কালো-কুলো দীন-দরিদ্র বেশ দেখে সৈনিকদের দল নিশ্চয় ওদের ভিখিরী ভাবতো। ভাবতো বলেই আমার খুব খারাপ লাগতো।

সেদিন কাঁটাতারের ওপার থেকে ওরা বখশিশ বখশিশ বলে চিৎকার করছে, কাঁধে আই ই খাকী বুশ শার্টের গার্ড জানকীনাথের সঙ্গে আমি গল্প করছি, আমাদের পাশ দিয়ে একজন অফিসার মচমচ করে যেতে যেতে চিৎকার শুনে থুথু ফেলার মতো গলায় বলে উঠলো, ব্লাডি বেগার্স
[উৎস: ভারতবর্ষ // রমাপদ চৌধুরী। গদ্য নির্বাচনে: ইন্দ্রনীল ঘোষ]


তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি অনির্বাণ বটব্যাল লিখলেন

সাদার সংক্রমণবিধি   

১. যেহেতু সাদার পথে নিয়ে চলো হে 

রাষ্ট্র শুয়ে থাকে দুধ সাদা খাওয়ার টেবিলে 
খাওয়া নয়... আহারের আহা-তেওগোপন থেকে যায়   
পুষ্টি বর্ধক চামচের ইহাই আচরণবিধি ... শক্তির সুষম বন্টনকাল 

ওহো দুধ তো সার্বজনীন নয় ... তার সাদাটিও নয় 
সাদার নেশা শুধু গুঁড়ো গুঁড়ো বিতরণ পায়রা উৎসবে 

দুধের শুকনো ঠাটবাঁট   
বাটোয়ারা শেখোনি বাটিতে বাটিতে, অথচ - 
উদ্যান বাটিতে তখন টইটুম্বূর ঝুলে আছে কুর্তা পাজামায়
উড়ু উড়ু সফেদ ফ্যানারা কী ভীষণ কল্পতরু -  
শান্তির অ্যাপ্রন পরে নিচ্ছে হাজার বছরের দায় 
কাদায় কাঁদাগুলি জমে প্যাচ প্যাচে পয়জারে 
উজবুকের উ-জুড়ে দিলে মৃত পশমের গায়ে 
উপশম ছড়িয়ে দেয় ভালো... ভালো... গুজব পাড়ায়  


২. অথচ মৃত্যুকেও যখন সাদা করিয়া তোলো   ... .

মৃত মানেই শীতল অন্ধকার বোঝো তুমি  ? 
মহতেও তো মোহ লেগে থাকে 

মৃত মানেই দেহ নয় হে ...
মৃত মানে বরফের সাদাটিও নয় ...  
ধবধবে মহোৎসব টাঙিয়ে রাখো সিংহ দরজায়  
আরো ... আরো চাই ... জনে জনে প্রজননে এস মহামারী  
সংক্রমণের বিছানা বালিশ দুগ্ধ ফেনিল ... আহা সাদার ম্যাজিক মাখো মহোল্লাসে 
হে চর্ব্য ... হে চোষ্য ...  হে উপাদেয় খিদে-সংক্রমণ  
অসংখ্য রমণ আর রমণীর পিঠে হাত রাখিয়া বলো  
আহা মাতঃ কোথা হইতে আনয়ন করিলে মৃত সন্ততি তোমার  
উহাকে ফুলশয্যা দাও... শ্বেতপুষ্পে ঢাকিয়া দাও পিত্তির মহিমাগুলি
বড় পাংশুটে হলদেটে ... সভ্যতার বেদীতে উহাকে সাদা করিয়া তোলো  

জনন আর জননীর মহামান্য কিঞ্চিতগুলি কুঞ্চিত হয় আরো  
ফুলে ওঠে সাদাস্রাবের আলজিভ। বালিকা ভুমির উদ্ভ্রান্ত চৌকাঠ।  
  

৩. তবুও সাদাই ইতর ঈশ্বর পবিত্র অন্ধকারের   

শ্বেত পরীর মত অ্যাম্বুলেন্স উড়ে এলে  
স্ট্রেচারে মুমূর্ষু খাদ্য প্রণালী ত্রাণ তহবিলে ... তুমি হালিমের অর্ডার দিলে
আবারো উঃ- জুড়িয়া হালুম লম্ফ দিয়া উঠিল  
দাঁতের সাদা  কি পেশীবহুল ... ভয়ঙ্কর সমীপেষু
খাদ্য ? নাকি খাদক সম্প্রদায়  

সাদায় তুমুল ঘটে গেলে হুলুস্থুল জড়ো হয় সাদার জরিপে
গেরিলা কৌশলে পুনরায় হিসেবের গুটিসুটি  ... গুটি নড়ে ওঠে রেশমের
সুতো ছাড়াতে থাকো ... সাদা রেশমের সুতো ...   
ও কি দাগ না দাগার সৌজন্য ক্ষত      
চাবুক না কাঁটাতারের সূক্ষ্ম সেলাই 
শিকার না শিকারীর  ঈশ্বর পিতা    
জমির না হজমির হারানো সিন্দুক   
  
ফোঁটা ফোঁটা শুশ্রষা গিলিয়ে দাও  
র‍্যাশনে দুধের লাইন ... খাজনা মুকুব
রাষ্ট্রের কোষাগারে 
               থরে থরে খিদের খাজানা ...

কুয়াশার চন্দনে সাদা আদমসুমারির মুখ ...  

আপনার মূল্যবান মন্তব্য

No comments:

Post a Comment