আমরা যে তিনটি গদ্যাংশ কবিকে দিয়েছিলাম
১.
বাঁকা
চাঁদ ছিল কি না, তা মফিজুদ্দিন পরে ভুলে যায়, এক
নির্জন শূন্যতার ভেতর রাতের গভীর প্রহরে সে রৌহার পানিতে বড়শি ফেলে বোয়াল মাছ ধরার
জন্য বসেছিল, তার পায়ের কাছে পানির ধার ঘেঁষে ছিল একটি ছোট্ট
হারিকেনের আলো; এই আলো পানিতে গিয়ে পড়েছিল এবং মফিজুদ্দিন
পাড়ের উপর অপেক্ষা করে ছিল। তখন নিদ্রামগ্ন চরাচরে কোনো শব্দ ছিল না, কেবলমাত্র তাঁর বড়শিতে টোপ হিসেবে গেঁথে দেয়া জ্যান্ত ব্যাঙটি থেকে থেকে
লাফালাফি করে পানিতে শব্দ এবং ছোট ছোট তরঙ্গ সৃষ্টি করছিল। মফিজুদ্দিনের মনে নাই,
তখন রাতের কয় প্রহর হয়েছিল; সে সময় তার চোখ
ছিল পানিতে ভেসে থাকা ফাৎনার উপর এবং মন ছিল বোবা মায়ের স্মৃতির শরীর ছুঁয়ে,
তখন হঠাৎ তার মনে হয়, অন্ধকারের ভেতর আলতো
পায়ে কেউ তার দিকে হেঁটে আসে। প্রথমে এ বিষয়ে তার কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, কিন্তু সেই মুহূর্তেই তার মনে হয় যে, এই নিশুতি রাতে
রৌহার ঘন জঙ্গলের ভেতর কোনো মানুষের এভাবে আসার কথা নয়, এবং
তখন তার মনে ভয় দানা বেঁধে ওঠে। তার মনে হয় যে, এটা হয়তো বা
মেছোভূত হবে, কাছে এসে নেকোস্বরে মাছ চাইবে, এঁকটো মাঁছ দেঁ, এবং তারপর পেছন ফিরে তাকানো মাত্র
ঘাড় মটকে দেবে; ভয়ে মফিজুদ্দিনের দেহে কাঁপুনি ধরে যায়,
কিন্তু সে ফাৎনার উপর থেকে চোখ সরায় না। তখন সেই আবছা শব্দটা তার
পেছন দিয়ে তাকে পার হয়ে একটু দূরে গিয়ে থামে, তারপর কেউ যখন তার কাছে
কোনো মাছ চায় না, সে তার মাথা একটুকুও না ঘুরিয়ে, চোখের কোনায় দেখতে পায় যে, বিলের পানির কিনারায় একজন
মানুষের মত কিছু একটা দাঁড়িয়ে আছে। মফিজুদ্দিন শরীরের কাঁপুনি বন্ধ করার চেষ্টা
করে, বিড়বিড় করে আল্লাহ কে ডাকে এবং তখন, সেই বিভ্রান্তি এবং আতঙ্কের ভেতর তার মনে হয় যে, অশরীরি
অস্তিত্বটির আসলে একটি পূর্ণাঙ্গ শরীর আছে, তার পা গুলোও মনে
হয় সামনের দিকে ফেরানো এবং তারপর, তখন, সে বুঝতে পারে, সেটা একটা নারীর শরীর। মফিজুদ্দিন
তখন সেই নারীর দিকে তাকায়, কেন এবং কীভাবে সে এই সাহস করে
উঠতে পারে, তা সে মনে করতে পারে না, তবে
রৌহার পাড়ের উপর দাঁড়ানো সেই নারীর দিকে তাকিয়ে সে তাকে চিনতে পারে, দুপুর রাতে বিলের কালো রঙের পানির কিনাড়ায় দাঁড়িয়ে ছিল চন্দ্রভান।
মফিজুদ্দিন প্রথমে ব্যাপারটা বুঝতে পারে নাই, এটা তার
বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে, চন্দ্রভান এভাবে এখানে এসে দাঁড়াতে
পারে; সে বড়শির ফাতনার কথা ভুলে চন্দ্রভানের দিকে এই বিস্ময়
নিয়ে তাকিয়ে থাকে যে, এত রাতে রৌহার এই জঙ্গলের ভেতর অমলিন
কিশোরী চন্দ্রভান কেন! তারপর তার সামনে এমন সব ক্রিয়া কর্ম সংঘটিত হয় যে, সে বুঝতে পারে, চন্দ্রভান রৌহার বিলের এই জায়গায়
কোনো এক স্বপ্নের সওদা করে যায়। মফিজুদ্দিন তখন সেই অন্ধকারে, অথবা আধো-অন্ধকারে অথবা জ্যোৎস্নায় দেখে যে, চন্দ্রভান
তার পরনের শাড়ি খুলে ফেলে, ব্লাউস খোলে এবং তারপর পেটিকোটের ফিতে খুলে
পায়ের কাছে ছেড়ে দেয়।
[উৎস: সে রাতে পূর্ণিমা ছিল // শহীদুল জহির। গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা]
২.
আর মাঝে
বেশ কিছু ব্যবধান রেখে দুটো দেশি ধরনের বাড়ি ছিল পশ্চিমমুখো। পাকা মেঝে, পাকা দেয়াল, টিনের রং-করা ছাদ, সামনে বড় আকারের পুকুর। আর আম, জাম, সবেদা সব ফলের গাছই ছিল পুকুরদুটোর বাউড়িতে। বাগানবাড়ির উত্তর দিকটায় কিছু দূরে
দামি গাছের একটা বনই ছিল। শাল, সেগুন, মেহগনি।
লাগানো বন, কাজেই গাছের মধ্যে মধ্যে ঝোপঝাড় ছিল না। ঘাসের
জমি ছিল। সে ঘাস গরুর জন্য কেটে নেয়ার পরে, দূর্বার মতো নরম
কচি ঘাসের খণ্ডখণ্ড চত্ত্বর হত। সেবার আমের ছুটিতে বাগানবাড়িতে গেলে সেই
গামছা-শাড়িপরা বালিকাটিই তাঁর ঘুরে বেড়ানোর সঙ্গী হত বটে। সে জানত কোন গাছে কোন আম, কোনটা ভাল জাতের। ঢাকা আমের জন্য বিখ্যাত নয়। সেখানে যদি ভালো আম, তা পূর্বপুরুষদের যত্নে হর্টিকালচারের সাহায্যে। আর তারই আন্দাজ ছিল
উত্তরের জঙ্গলে কোথায় ড্যাফল আর পানিয়াল ফল থাকতে পারে। সেই বালিকাই তাকে জ্ঞান
দিয়েছিল, পানিয়াল পেলে মার্বেলের মতো, সেই
ফল দুহাতের তালুর মধ্যে গড়িয়ে গড়িয়ে নরম করে খেতে হয়। কী যেন? আম পাকে, জাম পাকে, হাতে পাকে
পানিয়াল, বলে মন্তরও ছিল। সেদিন পানিয়াল পাওয়া যায়নি,
কিংবা পানিয়াল তখনো খাওয়ার মতো বড় হয়নি। আর সে জন্যই (এ কি
বিশ্বাসযোগ্য?) সে বালিকা তাঁর আধপাকা কুলের মত বুকদুটোকে দেখিয়ে পানিয়ালের
বদলে দুই হাতের মধ্যে নিয়ে পাকাতে বলেছিল। সে কি পানিয়াল না পাওয়ার অভিমান?
বা গ্রাম্য ঠাট্টা বা না হারার জেদ? আর তা থেকেই তার
পরেই, তার
নিজের সেই চাওয়া? জানত না সেই বালিকা কী দিতে পারে, আর সে নিজেই কী চাইছে। সেই পাপখেলা। কুঠিবাড়িতে পৌঁছে গেলেই কোনো ভয় ছিল
না, বিপদও পার। সেখানে কুলবাগানের ভুঁইমালি, রসুই-বামুন, কুঠির কেয়ারটেকার বৃদ্ধ ঘোষমশাই।
মোক্তার সাহেবের একমাত্র ছেলে সেখানে নিরাপদ। ততদূর পাপ যায় না।
ঋষি
উকিল বললেন, শোনো করবী। আমার কোর্টে যাওয়ার গাড়িও এসে গেছে। গাড়িতে
যেতে যেতে তোমার মামলার বিবরণ শুনব। কোর্টের হাতায় তোমার ফল মিষ্টি ডাবের ব্যবস্থা
হবে।
ঋষি
উকিল তখনও হাওয়াগাড়ি কেনেননি। কেননা তাঁর পিতা মোক্তারসাহেবের আমলের দুই ঘোড়ার কোচ, বড় দুই ওয়েলার ঘোড়া, কোচম্যান সহিস– সব মিলে বেশ আভিজাত্যপূর্ণ মনে হয়। ভিতরের গদিগুলো উজ্জ্বল চামড়ায় মোড়া,
দেয়ালে মেহগনি বার্নিশ। দুই দরজা, চার জানালা।
জানালায় কাচগুলো হালকা নীলের নকশাদার। পিতার আমলের ওয়েলারদুটোর বয়স হয়ে যাওয়াতে বছরখানেক
আগে সে দুটোর বদলে বর্তমানের দুটো কেনা হয়েছে। এ দুটির রং প্রায় কালো। তারা আট
পায়ে খপ খপ শব্দ তুলে কোর্ট-চত্ত্বরে ঢুকে জানান দেয়, ঋষি
সেন এম এ, এম এল, অ্যাডভোকেট এলেন।
বলা
বাহুল্য আমাদের কল্লোলিনী কলকাতা-কালচারের দৃষ্টিতে এসবই, এই গল্পটাই, সেকেলে, ঢাকাই,
বাঙালে কাণ্ডকারখানা মনে হতে পারে।
সহিস
পাদানের ওপরে গেট খুলে দিলে, ঋষি সেন গাড়িতে উঠে বললেন, উঠে এসো করবী, পথেই তোমার মামলার বিবরণ জেনে নেব।
এমনকী
ঋষি সেন অ্যাডভোকেট তাঁর সদ্য আগত সেই মক্কেল করবী দাসকে হাত ধরে কোচে উঠতে
সাহায্য করলেন। ব্যাপারটা কোচম্যান ও সহিসের চোখে পড়ায় তারা বিস্মিত হল। আর তার
জেরেই যেন ভাবলেন, কোচটা বাগানবাড়ি আর করবীকেই মানায়,
তিনি না হয় দু-একদিনের মধ্যে লেটেস্ট মডেল একটা ফোর্ড কিনে নেবেন।
তখনো কিন্তু বিস্মিতপ্রায় সেই নয়-দশ বছরের মেয়েটির সেই থেকে আজ পর্যন্ত কী জীবন
কেটেছে, কেন খুনের মামলায় পড়েছে তা জানা হয়নি।
৩.
[উৎস: অতি বিরল প্রজাতি // অমিয়ভূষন মজুমদার। গদ্য নির্বাচনে: অভিষেক ঝা]
ভিখুর
গলা জড়াইয়া ধরিয়া পাঁচী তাহার পিঠের উপর ঝুলিয়া রহিল। তাহার দেহের ভারে সামনে
ঝুঁকিয়া ভিখু জোরে জোরে পথ চলিতে লাগিল। পথের দু’দিকে ধানের ক্ষেত
আবছা আলোয় নিঃসাড়ে পড়িয়া আছে। দূরে গ্রামের গাছপালার পিছন হইতে নবমীর
চাঁদ আকাশে উঠিয়া আসিয়াছে। ঈশ্বরের পৃথিবীতে শান্ত স্তব্ধতা।
হয়তো ওই
চাঁদের এই পৃথিবীর ইতিহাস আছে। কিন্তু যে ধারাবাহিক অন্ধকার মাতৃগর্ভ হইতে সংগ্রহ
করিয়া দেহের অভ্যন্তরে লুকাইয়া ভিখু ও পাঁচী পৃথিবীতে আসিয়াছিল এবং যে অন্ধকার
তাহারা সন্তানের মাংসল আবেষ্টনীর মধ্যে গোপন রাখিয়া যাইবে তাহা প্রাগৈতিহাসিক, পৃথিবীর আলো আজ
পর্যন্ত তাহার নাগাল পায় নাই, কোনোদিন পাইবেও না।
[উৎস: প্রাগৈতিহাসিক // মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়। গদ্য নির্বাচনে: রূপা দাস ও সাধন দাস]
তিনটি গদ্যাংশ থেকে কবি তন্ময় হালদার লিখলেন
১.
জীবন ধরতে গেলে আমি বিকেন্দ্রীভূত
জলজ থেকে জল বাদ দিলে
চাঁদরেখা ভুলিয়ে দেয় রাতারাতির স্তর
সুমাইয়া বাতাস বইতে থাকে
২.
ফাতনা - বহির্বিশ্ব আর জলজগতের মধ্যবর্তী
৩.
৪.
মনে হতে পারে উপাদানহীন। তারপরে
৫.
নিষিক্ত সিক্ত হব
কী জানে জানি না
৬.
যেভাবে ঘুরছে তা ঘোরাতে পারছি না
আমি মফিজুদ্দিন অবোধচন্দ্র
Duronto lekhoni. Tinti godder e sarthak atmik dehantar ghoteche kobitai. Sudhu tritio goddyangshotir adim rahasyomaiota ki ar ektu besi babohar kara jatona kobitai!
ReplyDeleteআপনার মূল্যবান মতামতের জন্য ধন্যবাদ।
Delete